প্রাক
পরিচিতিঃ
বাংলার
প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে বরেন্দ্র ভূমির এই স্থল ভাগটি
এক প্রাচীন জনপদ। কথিত আছে এই উপজেলার মধ্য
দিয়ে প্রবাহিত এক সুবিস্তৃত নদী
চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যিক পথ হিসাবে ব্যবহৃত
হত । অনেকের মতে
মহামূল্যবান মণির ব্যবসা কেন্দ্র হিসাবে লালমনিরহাট অতীতে পরিচিতি লাভ করে। বিশেষ করে লাল রংয়ের মণির বিপনী কেন্দ্র হিসাবে লালমনিরহাট নামকরণের জনশ্রুতি আছে। কৌতুহল উদ্দীপক নানা বিচিত্র ঘটনার মধ্য দিয়ে এই উপজেলার যাত্রা
শুরু হয়েছে। বিবর্তন ও বৈচিত্র্যের অনেক
ঘটনাই এখন কুয়াশাচ্ছন্ন। অতীতে এটি কোচবিহার অঙ্গরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি জনপদ ছিল।
উপজেলার
নামকরণ, জনপদের নামকরণ ও উপজেলার সৃষ্টির
ইতিহাসঃ
অনেক
সভ্যতার উত্থান পতনের পাদপীঠ বরেন্দ্র ভূখন্ড। তারই শেষ প্রান্তে পল্লী প্রকৃতির রুপ মাধুর্য আর সবুজের স্নিগ্ধতায়
ভরা কালীগঞ্জ উপজেলা। এই উপজেলার প্রাণ
কেন্দ্র তুষভান্ডার। তুষভান্ডার জমিদার বংশ অনেক প্রাচীন। জমিদারীর গোড়পত্তন ঘটে সম্রাট শাহজাহানের আমলে ১৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে। বংশের আদি পুরুষ মুরারী দেব ঘোষাল ভট্টাচার্য। জন্ম স্থান কলকাতা। তিনি ছান্দোর বংশের রাজ পরিবারের সন্তান। রাজা আদিশূর তাঁকে নিয়ে আসেন। মুরারী দেব ঘোষাল একজন পন্ডিত ছিলেন। তিনি ‘‘রশিক রায় বিগ্রহ’’ কে নিয়ে এ
অঞ্চলে আসেন। এই বিগ্রহ তুষভান্ডার
জমিদার বাড়ীতে প্রতিষ্ঠা করা হয় (১৩৭৫ বাং এর পরে ঐ
বিগ্রহের কোন চিহ্ন পাওয়া যায় নাই)। ঘটনাক্রমে ১৬৩৪ইং
সালে তিনি কোচবিহার রাজ্যের রাজধানীতে উপস্থিত হন। তখন কোচবিহার রাজ্য বৃহত্তর রংপুরের শেষ সীমানায় প্রবাহিত করতোয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
এখানকার
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁকে আকৃষ্ট করে। সহজ সরল মানুষের ব্যবহারে তিনি মুগ্ধ হন। ফলে তৎকালীন কুচবিহারের মহারাণীর (যিনি ডাঙ্গার মাই নামে পরিচিত ছিলেন) নিকট স্থানীয়ভাবে বসবাস করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। মহারাণী তখন এই সেবার জন্য
ঘনেশ্যাম, ছোটখাতা, বামুনিয়া, শেখ সুন্দরসহ নয়টি মৌজা তাকে দান করেন। মহারাণী কোচ বংশীয় শুদ্রা ছিলেন। শুদ্রের দান গ্রহণে মুরারী দেব অনিচ্ছুক হওয়ায় প্রদত্ত সম্পত্তির কিছু খাজনা গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। মহারাণী তখন এই জমিদারীতে উৎপন্ন
ধানের তুষ পাঠাতে বলেন। এই তুষ শাস্ত্রীয়
যজ্ঞাদিতে ব্যবহৃত হত। বর্তমান জমিদার বাড়ীর পাশেই এই তুষের স্তুপ
রক্ষিত ছিল। এই তুষের স্তুপ
থেকেই তুষভান্ডার নামের উৎপত্তি।
১৮২৪ সালের কোন এক সময়ে তুষভান্ডার
জমিদারের উত্তরসূরী হিসেবে কালী প্রসাদ রায় চৌধুরী জমিদারী প্রাপ্ত হন। তিনি বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় অনেক জনকল্যাণকর কাজ সাধিত হয় এবং অচিরেই
তিনি একজন ধর্মপ্রাণ ও সদয় ব্যক্তি
হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বর্তমান কালীগঞ্জ থানা তারই নাম অনুসারে নামকরণ করা হয়েছে।
এ থানার পূর্ব
নাম ‘‘ফোড়ণবাড়ী’’। শিয়ালখোওয়া হাটের
উত্তরে সতী নদীর পাড় হয়ে উত্তর মূখী রাসত্মা ধরে এগিয়ে গেলেই লোহাকুচি যাবার রাস্তার সংযোগ স্থলে এই ফোড়ণবাড়ী থানার
অবস্থান ছিল। এলাকাটি যেমন দুর্গম তেমনি নির্জন ছিল। মাঝে মাঝে কর্তব্যরত সিপাহীরাও মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করত। এরূপ একটি নির্মম ঘটনার তদমেত্ম ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট
EG.Glazier.Esq.C.S থানাটি
স্থানান্তরের সুপারিশ করেন।
এই সুযোগে জমিদার
দারোগার সাথে পরামর্শ করে প্রজাদের নিয়ে থানা ভেঙ্গে নিয়ে আসেন এবং একখন্ড জমি বেঙ্গল পুলিশ কর্তৃপক্ষকে দান করেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্য তাঁর কর্মোদ্যম ও সাহসের প্রশংসা
করেন এবং কালীগঞ্জ নামকরণটি অনুমোদনের সুপারিশ করেন। এই কালীগঞ্জ থানা
সৃষ্টির তারিখ থেকে জলপাইগুড়ি জেলার একটি পূর্নাঙ্গ থানা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর এই উপজেলাটি
রংপুর সদর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং ১৯৮১
সালে লালমনিরহাট জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং একই
সালে উপজেলা হিসেবে ১৯৮২ সালে যাত্রা শুরু করে। এসময়ে কালীগঞ্জ থানার ৮টি ইউনিয়নকে নতুন আদিতমারী উপজেলার অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
তুষভান্ডার
জমিদার পরিবারের তার পুত্র রমনী মোহন জমিদারীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। রমনী মোহন প্রজা ভক্ত জমিদার ছিলেন। ১৮৭২ সালে তিনি একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন (বর্তমানে এটি একটি জছির উদ্দিন বিদ্যানিকেতন)। ১৮৭৫ সালে
এখানে একটি সাবরেজিস্ট্রি অফিস স্থাপন করা হয়। ১৮৭২ সালে তুষভান্ডারে এতদ অঞ্চলের প্রথম হাইস্কুল স্থাপিত হয়। এটি রাজা রমনী মোহনের নামে পরিচিতি লাভ করে। তিনি কয়েকটি ধর্ম মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন।
কিভাবে যাওয়া
যায়:
ঢাকা
থেকে বাস/রেল পথে যোগে লালমনিরহাট হয়ে তুষভান্ডার যেতে হবে। দূরত্ব প্রায় ৩৭২ কি মি.।
লালমনিরহাট শহর হতে প্রায় ৩১ কি মি
দূরে তুষভান্ডার জমিদারবাড়ি অবস্থিত।