কাকিনা জমিদারী বংশ ও জমিদার বাড়ী


বৃহত্তর রংপুর জেলার অন্যতম জমিদারী ছিল কাকিনার জমিদার। ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে মোগলদের দেয়া সনদমূলে কাকিনার জমিদারির সূচনা হয়। সে সময় ঘোড়াঘাটের মোগল ফৌজদার এবাদত খাঁ কোচ রাজা মহিন্দ্র নারায়নের সঙ্গে এক যুদ্ধে কোচ রাজ্যের ৬টি পরগনার মধ্যে কাকিনা, ফতেপুর কাজিরহাট দখল করে নেয়। ওই সময় দিল্লীতে মোগল সম্রাট ছিলেন আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার ছিলেন তাঁর মামা শায়েস্তা খাঁ এবং ঘোড়াঘাটের ফৌজদার ছিলেন শায়েস্তা খাঁর ছেলে এবাদত খাঁ।

এবাদত খাঁ পরগনা দখলের পর কোচবিহারের নাজির শত্ত নারায়নকে কর নির্ধারণ পূর্বক এর জমিদারির বন্দোবস্ত করতে অসম্মত হলে কাকিনা পরগনার প্রভাবশালী কর্মচারী রঘু রামের চার পুত্রের মধ্যে রামনারায়নকে কাকিনা জমিদারি সনদ প্রদান করেন। পরবর্তীতে রাজা রায় চৌধুরী জমিদারী  লাভ করেন। পরবর্তীতে রুদ্র রায় রসিক রায় হয়ে অলকা দেবী উক্ত জমিদারী প্রাপ্ত হন। অলকা দেবী অপুত্রক হওয়ায় রাম রাদ্ররায় চৌধুরীকে দত্তক গ্রহণ করেন। ১৮৮৪ সালে তৎকালীন রংপুর জেলা কালেক্টর পিটার মুর রাম রুদ্র রায় চৌধুরীকে কাকিনা জমিদার হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। সময় বুকানন হ্যামিল্টন কাকিনা ভ্রমন করেন।

১৮৪৯ সালে শম্ভুচরণ রায় চৌধুরী কাকিনার জমিদার হন। শম্ভুসাগর নামে বিরাট দিঘিটি তারই কীর্তি। ১৮৬০ সালের এপ্রিল মাসে ‘‘রঙ্গপুর প্রকাশ’’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা তার অর্থায়নে প্রকাশিত হয় এটি বৃহত্তর রংপুর জেলার প্রথম পত্রিকা। এরপর তার দত্তক পুত্র মহিমা রঞ্জন রায় চৌধুরী ১৮৭৪ সালে জমিদারীর দায়িত্ব পান। মহিমা রঞ্জন প্রজা বৎসল এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি সেবী জমিদার ছিলেন। তিনি কাকিনায় একটি বিশাল লাইব্রেরী গড়ে তোলেন। ১৯০৮ সালে বগুড়ার ‘‘উডবার্ণ’’ লাইব্রেরীটির তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। রংপুর জেলার রেলপথ প্রসারে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। মহেন্দ্রনগর এবং মহিমাগঞ্জ রেল স্টেশন দুটি তার পুত্র নিজ নামে কীর্তিকে স্মরণীয় করে রেখেছে। কাকিনায় তিনি একটি জাদুঘরও স্থাপন করেন। রংপুর সাহিত্য পরিষদের তিনি প্রথম সভাপতি (১৯০৭)

রংপুর শহরে কৈলাশ রঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন কাকিনার জমিদার। তাঁর ফেলে যাওয়া জমিদার বাড়ীর সামনে মহিমা রঞ্জন স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়টি ‘‘হাই ইংলিশ স্কুল’’ প্রতিষ্ঠা পায় তাঁর মৃত্যুর পরপর ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও এই বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু ১৮৫৮ সালে। জমিদারীর বিশাল ব্যাপ্তির কারণে কাকিনা জমিদারী ‘‘কাকিনা রাজবাড়ী’’ নামে পরিচিত ছিল।

বর্তমানের কালীগঞ্জ উপজেলাধীন কাকিনা ইউনিয়নের কাকিনা মৌজায় এক কালে গড়ে উঠেছিল বড় বড় ইমারত বিশিষ্ট জমিদার বাড়ী, যা কালের স্রোতে নিশ্চি হয়ে গেছে। কাকিনা জমিদার বাড়ীর অতীত স্মৃতি ধারণ করে এখন নীরবে দাড়িয়ে রয়েছে শুধুমাত্র- "হাওয়াখানা'

ইতিহাস বিশ্লেষণে জানা যায়, মহারাজা মোদ নারায়নের সময় কাকিনা ছিল কোচবিহার রাজ্যাধীন একটি চাকলা। তৎকালে কাকিনার চাকলাদার ছিলেন ইন্দ্র নারায়ণ চত্রুবর্তী। ১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ঘোড়াঘাটের ফৌজদার এবাদত খাঁ মহারাজা মোদ নারায়ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে কোচ রাজ্যে অভিযান চালানোর সময় রঘু রামের দু'পুত্র রাঘবেন্দ্র নারায়ণ রাম নারায়ণ ফৌজদারের পক্ষ অবলম্বন করেন। মোগলদের অভিযানে কোচ বাহিনী পরাজিত হলে ইন্দ্র নারায়ণ চত্রুবর্তীকে কাকিনার চাকলাদার পদ থেকে অপাসারণ করা হয় এবং রাঘবেন্দ্র নারায়ণকে পরগনা বাষট্রি রাম নারায়ণকে পরগনা কাকিনার চৌধুরী নিযুক্ত করা হয়। এভাবেই ইন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তীর চাকলাদারী শেষ হয়ে কাকিনায় রাম নারায়ণের মাধ্যমে নতুন জমিদারীর সূচনা ঘটে। রাম নারায়ণ চৌধুরীর পিতা রঘু রাম সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, চাকলাদার ইন্দ্র নারায়ণ চত্রুবর্তীর সময় তিনি কাকিনা চাকলার একজন সাধারণ কর্মচারী ছিলেন। তবে রঘু রামের পিতা রমা নাথ ১৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে কোচবিহার মহারাজা প্রাণ নারায়ণের সময় (১৬৩২-৬৫ খ্রিঃ) রাজ দফ্তরে মজুদদারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দে রাম নারায়ণ কাকিনা পরগনার চৌধুরী নিযুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে কাকিনায় যে জমিদারীর সূচনা ঘটেছিল, জমিদার মহেন্দ্ররঞ্জনের সময় তাঁর অপরিণামদর্শী ব্যয় বিলাসিতার কারণে তা ধ্বংসের মুখে পতিত হয়। মহাজনদের বকেয়া সরকারি রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জমিদারী নিলাম হয়ে যায় এবং এর পরিচালনার ভার কোর্ট অব ওয়ার্ডস- এর অধীন চলে যায়। অতঃপর তিনি প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় সপরিবারে কাকিনা ত্যাগ করে কার্সিয়াং (দার্জিলিং)- চলে যান। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে সেখানেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে।

কিভাবে যাওয়া যায়:
সড়ক পথ/রেলপথ ঢাকা হতে ৩৬৮ কিঃমিঃ ঢাকা থেকে ঢাকা-লালমনিরহাট জাতীয় মহাসড়ক পথে লালমনিরহাট হয়ে পুনরায় লালমনিরহাট হতে বুড়িমারী (পাটগ্রাম উপজেলা) স্থল বন্দরগামী রাস্তায় মহাসড়ক পথে (লালমনরিহাট হতে প্রায় ২১কিঃমিঃ) কাকিনা বাজার বাসস্ট্যান্ড। বাসস্ট্যান্ড হতে ২০০ গজ পশ্চিমে জমিদার বাড়ির ভগ্নাবশেষ অবস্থিত। লালমনিরহাট থেকে লালমনিরহাট- বুড়িমারি মহাসড়ক পথে প্রায় ২১ কিঃমিঃ দূরে জমিদারবাড়ি অবস্থিত। রংপুর হতে লালমনিরহাট হয়ে বুড়িমারি স্থল বন্দরের রাস্তায় ৬৬ কি মি দূরে জমিদারবাড়ি অবস্থিত। রেলপথ রেলপথঃ লালমনিরহাট হতে বুড়িমারি রেলপথে কাকিনা রেল স্টেশন নেমে প্রায় কি মি দক্ষিণ দিকে জমিদারবাড়ি অবস্থিত।

Post a Comment

Previous Post Next Post