অতীশ
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান হলেন একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত যিনি পাল সাম্রজ্যের আমলে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধধর্মপ্রচারক ছিলেন।
জন্ম
মহামহোপাধ্যায়
সতীশ্চন্দ্র বিদ্যাভূষণ ও রাহুল সাংকৃত্যায়নের
মতানুসারে পালযুগে মগধের পূর্ব সীমান্তবর্তী প্রদেশ অঙ্গদেশের পূর্ব প্রান্তের সামন্তরাজ্য সহোর, যা অধুনা ভাগলপুর
নামে পরিচিত, তার রাজধানী বিক্রমপুরীতে সামন্ত রাজা কল্যাণশ্রীর ঔরসে রাণী প্রভাবতী দেবীর গর্ভে ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে অতীশ দীপঙ্করের জন্ম হয়। [২] কিন্তু কিছু
ঐতিহাসিকের মতে তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
শৈশব
ছোটবেলায়
তাঁর নাম ছিল আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ। তিন ভাইয়ের মধ্যে অতীশ ছিলেন দ্বিতীয়। তার অপর দুই ভাইয়ের নাম ছিল পদ্মগর্ভ ও শ্রীগর্ভ। অতীশ
খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেন। কথিত আছে তার পাঁচ স্ত্রীর গর্ভে মোট ৯টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন।[৩] তবে পুন্যশ্রী
নামে একটি পুত্রের নামই শুধু জানা যায়।
শিক্ষা
প্রাথমিক
শিক্ষা গ্রহণ করেন মায়ের কাছে। তিন বছর বয়সে সংস্কৃত ভাষায় পড়তে শেখা ও ১০ বছর
নাগাদ বৌদ্ধ ও অবৌদ্ধ শাস্ত্রের
পার্থক্য বুঝতে পারার বিরল প্রতিভা প্রদর্শন করেন তিনি। মহাবৈয়াকরণ বৌদ্ধ পণ্ডিত জেত্রির পরামর্শ অনুযায়ী তিনি নালন্দায় শাস্ত্র শিক্ষা করতে যান।[৪]
১২
বছর বয়সে নালন্দায় আচার্য বোধিভদ্র তাঁকে শ্রমণ রূপে দীক্ষা দেন এবং তখন থেকে তাঁর নাম হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। ১২ থেকে ১৮
বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বোধিভদ্রের গুরুদেব অবধূতিপাদের নিকট সর্ব শাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন করেন। ১৮ থেকে ২১
বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বিক্রমশীলা বিহারের উত্তর দ্বারের দ্বারপন্ডিত নাঙপাদের নিকট তন্ত্র শিক্ষা করেন। এরপর মগধের ওদন্তপুরী বিহারে মহা সাংঘিক আচার্য শীলরক্ষিতের কাছে উপসম্পদা দীক্ষা গ্রহণ করেন।[২] ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের
জন্য তিনি পশ্চিম ভারতের কৃষ্ণগিরি বিহারে গমন করেন এবং সেখানে প্রখ্যাত পন্ডিত রাহুল গুপ্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ শাস্ত্রের আধ্যাত্নিক গুহ্যাবিদ্যায় শিক্ষা গ্রহণ করে ‘গুহ্যজ্ঞানবজ্র’ উপাধিতে ভূষিত হন।
দীপঙ্কর
১০১১ খ্রিস্টাব্দে শতাধিক শিষ্যসহ মালয়দেশের সুবর্ণদ্বীপে (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ) গমন করেন এবং আচার্য ধর্মপালের কাছে দীর্ঘ ১২ বছর বৌদ্ধ
দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ের উপর অধ্যয়ন করে স্বদেশে ফিরে আসার পর তিনি বিক্রমশীলা
বিহারে অধ্যাপনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
তিব্বত
যাত্রা
তিব্বতের
সম্রাট ল্হ-লামা-য়েশো কয়েক জন দূতের হাতে
প্রচুর স্বর্ণ উপঢৌকন দিয়ে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বত ভ্রমনের আমন্ত্রন জানালে দীপঙ্কর সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এতে নিরাশ না হয়ে সম্রাট
সীমান্ত অঞ্চলে সোনা সংগ্রহের জন্য গেলে গরলোগ অঞ্চলের অধিপতি তাঁকে বন্দী করেন ও প্রচুর সোনা
মুক্তিপণ হিসেবে দাবী করেন। সম্রাট তাঁর পুত্র লহা-লামা-চং-ছুপ-ও
কে মুক্তিপণ দিতে বারণ করেন এবং ঐ অর্থ দীপঙ্কর
শ্রীজ্ঞানকে তিব্বতে আনানোর জন্য ব্যয় করতে বলেন। লহা-লামা-চং-ছুপ-ও
সম্রাট হয়ে গুং-থং-পা নামে
এক বৌদ্ধ উপাসককে ও আরো কয়েক
জন অনুগামীকে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বতে আনানোর দায়িত্ব দেন। এরা নেপালের পথে বিক্রমশীলা বিহারে উপস্থিত হন এবং দীপঙ্করের
সাথে সাক্ষাৎ করে সমস্ত সোনা নিবেদন করে ভূতপূর্ব সম্রাট ল্হ-লামা-য়েশোর বন্দী হওয়ার কাহিনী ও তাঁর শেষ
ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করলে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অভিভূত হন। আঠারো মাস পরে ১০৪০ খৃস্টাব্দে বিহারের সমস্ত দায়িত্বভার লাঘব করে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বত যাত্রার জন্য প্রস্তুত হন। তিনি দোভাষী সহ বারো জন
সহযাত্রী নিয়ে প্রথমে বুদ্ধগয়া হয়ে নেপালের রাজধানীতে উপস্থিত হন এবং নেপালরাজের
আগ্রহে এক বছর সেখানে
কাটান। এরপর নেপাল অতিক্রম করে থুঙ বিহারে এলে তাঁর দোভাষী ভিক্ষু গ্য-চোন-সেঙ অসুস্থ হয়ে মারা যান। ১০৪২ খৃস্টাব্দে তিব্বতে র পশ্চিম প্রান্তের
ডংরী প্রদেশে পৌছন। সেখানে পৌছলে লহা-লামা-চং-ছুপ-ও
এক রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন করে তাঁকে থোলিং বিহারে নিয়ে যান। এখানে দীপঙ্কর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ বোধিপথপ্রদীপ রচনা করেন। ১০৪৪ খৃস্টাব্দে তিনি পুরঙে, ১০৪৭ খৃস্টাব্দে সম-য়ে বৌদ্ধ
বিহার ও ১০৫০ খৃস্টাব্দে
বে-এ-বাতে উপস্থিত
হন।
তিব্বতে
বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার
দীপঙ্কর
তিব্বতের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। তিনি তিব্বতী বৌদ্ধধর্মে প্রবিষ্ট তান্ত্রিক পন্থার অপসারণের চেষ্টা করে বিশুদ্ধ মহাযান মতবাদের প্রচার করেন। তিনি তিব্বতে কদম-পা নামে এক
লামা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করেন।
রচনা
দীপঙ্কর
শ্রীজ্ঞান দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন।
তিব্বতের ধর্ম, রাজনীতি, জীবনী, স্তোত্রনামাসহ তাঞ্জুর নামে বিশাল এক শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলন
করেন। বৌদ্ধ শাস্ত্র, চিকিৎসা বিদ্যা এবং কারিগরি বিদ্যা বিষয়ে তিব্বতী ভাষায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেন বলে তিব্বতীরা তাকে অতীশ উপাধীতে ভূষিত করে। অতীশ দীপঙ্কর অনেক সংস্কৃত এবং পালি বই তিব্বতী ভাষায়
অনুবাদ করেন। দীপঙ্করের রচিত গ্রন্থগলির মধ্যে বোধিপথপ্রদীপ, চর্যা-সংগ্রহপ্রদীপ, সত্যদ্বয়াবতার, মধ্যমোপদেশ, সংগ্রহগর্ভ, হৃদয়-নিশ্চিন্ত, বোধিসত্ত্ব-মণ্যাবলী, বোধিসত্ত্ব-কর্মাদিমার্গাবতার, শরণাগতাদেশ, মহযান-পথ-সাধন-বর্ণ-সংগ্রহ, শুভার্থ-সমুচ্চয়োপদেশ, দশ-কুশল-কর্মোপদেশ,
কর্ম-বিভঙ্গ, সমাধি-সম্ভব-পরিবর্ত, লোকোত্তর-সপ্তকবিধি, গুহ্য-ক্রিয়া-কর্ম, চিত্তোৎপাদ-সম্বর-বিধি-কর্ম, শিক্ষাসমুচ্চয়-অভিসময় ও বিমল-রত্ন-লেখনা উল্লেখযোগ্য।[৭] বিখ্যাত পন্ডিত
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং ইতালির বিখ্যাত গবেষক টাকি দীপঙ্করের অনেকগুলো বই আবিস্কার করেন।[৬]
মৃত্যু
তিব্বতে
বৌদ্ধ ধর্মে সংস্কারের মতো শ্রমসাধ্য কাজ করতে করতে দীপঙ্করের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে ১০৫৪ খৃস্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে
তিব্বতের লাসা নগরের কাছে চে-থঙের দ্রোলমা
লাখাং তারা মন্দিরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।[৬][২]
তথ্যসূত্র
↑ "Portrait
of Atisha [Tibet (a Kadampa monastery)] (1993.479)"। Timeline of Art History। New York: The
Metropolitan Museum of Art, 2000–।
October 2006। সংগৃহীত 2008-01-11।
↑ ২.০ ২.১ ২.২
২.৩ তিব্বতে সওয়া
বছর - রাহুল সাংকৃত্যায়ন, অনুবাদ - মলয় চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক - চিরায়ত প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেড, ১২ বঙ্কিম চ্যাটার্জি
স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০৭৩, ISBN 81-85696-27-6
↑ ৩.০ ৩.১ "চন্দ্রগর্ভ থেকে শ্রীজ্ঞান" - ত্রৈমাসিক ঢাকা, ১ম বর্ষ, ১ম
সংখ্যা, পৃষ্ঠা ১২
↑ ৪.০ ৪.১ অতীশ দীপঙ্কর
শ্রীজ্ঞানের খোঁজে,অদিতি ফাল্গুনী, দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা থেকে প্রকাশের তারিখ: ২৬-০৯-২০১১
খ্রিস্টাব্দ।
↑ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশ, বাংলা বিশ্বকোষ। দ্বিতীয় খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান। ডিসেম্বর ১৯৭৫, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। প্রথম খণ্ড। জানুয়ারি ২০০২।
↑ ৬.০ ৬.১ ৬.২
মুন্সিগঞ্জের বজ্রযোগিনী গ্রামে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের বাস্ত ভিটা,মো: রুবেল, বাংলাদেশ বার্তা ডট কম। ঢাকা
থেকে প্রকাশের তারিখ: ৮ মার্চ,২০১২
খ্রিস্টাব্দ।
↑ স্বামী অভেদানন্দের কাশ্মীর ও তিব্বত ভ্রমণ
- প্রকাশক- শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, কলকাতা ৭০০০০৬, ISBN
978-81-88446-83-4
কিভাবে
যাওয়া যায়:
ঢাকার
পার্শ্ববর্তী জেলা মুন্সীগঞ্জ। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী ইউনিয়েনের বজ্রযোগিনী গ্রামে অতীশ দীপঙ্করের পণ্ডিত ভিটা ও অডিটরিয়াম অবস্থিত।
সড়কপথে ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জের দূরুত্ব মাত্র ২৩ কিলোমিটার। তবে
অতীশ দীপঙ্করের পণ্ডিত ভিটা ও অডিটরিয়াম দেখার
জন্য আরো ০৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে আসতে হবে। ঢাকা হতে সকালে এসে অতীশ দীপঙ্করের পণ্ডিত ভিটা ও অডিটরিয়াম দর্শন
করে বিকেলেই ঢাকায় ফিরে আসা যাবে। সড়কপথে যেতে কষ্ট হবে না। তবে নৌপথে গেলে সময়ও বাচঁবে এবং যানজট এড়িয়ে নদী পথের সৌন্দর্য অবগাহন করে সাচ্ছন্দের সাথে পৌছানো যাবে। সদর ঘাট থেকে মুন্সীগঞ্জগামী লঞ্চে ২ ঘন্টার মধ্যেই
পৌছে যাওয়া যাবে মুন্সীগঞ্জ লঞ্চ ঘাটে। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা হইতে রিক্সা / টেম্পু যোগে বজ্রযোগিনী ইউনিয়নের বজ্রযোগিনী গ্রামে অতীশ দীপঙ্করের পণ্ডিত ভিটা অবস্থিত। রিক্সা ভাড়া ৪০-৫০ টাকা।