বাংলার রাজা-জমিদারদের মধ্যে দিঘাপতিয়া রাজবংশ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। দয়ারাম রায় এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর জন্মবৃত্তান্ত আজো রহস্যাবৃত্ত। কারো মতে, দয়ারাম রায় কলম গ্রামের এক তিলি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ন ঠাকুরের অধীনে সাধারণ একজন কর্মচারী তখন দয়ারাম তাঁর মাসিক ৮ আনা বেতনে চাকুরী করতেন। পরে সামান্য লেখাপড়া করে জমা খরচ রাখার মত যোগ্যতা অর্জন করেন এবং রামজীবন তাকে মাসিক ৮ আনার পরিবর্তে ৫ টাকা বেতনের মহুরী নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়নের স্নেহ, ভালবাসা ও সহানুভুতি, নবাব সরকারের ভ্রাতা রঘুনন্দনের প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং বাংলার নবাব দেওয়ান মুর্শিদকুলী খানের নেক-নজর সবকিছু মিলে যখন রামজীবন জমিদারী লাভ করেন তখন তারও ভাগ্য খুলতে থাকে। অনেকের মতে রামজীবন জলবিহারোপলক্ষ্যে চলনবিলের মধ্য দিয়ে কলম গ্রামে পৌছেন। সে সময় দু’জন বালক রাজার নৌকার সামনে উপস্থিত হয়। দু’টি বালকের একজনের কথাবার্তা ও বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে তিনি তাকে নাটোরে নিয়ে আসেন। বালকটিই দয়ারাম রায়।
দয়ারাম রায় সিংড়া থানার কলম গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কলমের নরসিংহ রায়ের সন্তান তিনি অনুমান ১৬৮০ সালে তার জন্ম। প্রথমে রাজা রামজীবনের একজন সাধারণ কর্মচারী এবং প্রতিভাবলে নাটোর রাজের দেওয়ান পর্যন্ত হয়েছিলেন। রামজীবন তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন এবং প্রচুর অর্থ-সম্পদ তার কাছে গচ্ছিত রাখতেন। রাজা সীতারাম রায়ের পতনের পর দয়ারাম নাটোর রাজ্যের একজন পরাক্রমশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। যশোহরের রাজা সীতারাম রায় বিদ্রোহী হলে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ নাটোর রাজের দেওয়ান দয়ারাম রায়ের সাহায্যেই দমন ও পরাজিত করে নাটোর কারাগারে বন্দী করেন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করায় নবাব সরকারের প্রভাব বেড়ে যায় এবং ‘‘রাই রাইখা’’ খেতাবে ভূষিত হন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করে তিনি তার মূল্যবান সম্পদ সমূহ লুন্ঠন করেন, কিন্তু গৃহদেবতা কৃষ্ণজীর মূর্তি ছাড়া সব রামজীবনের হাতে তুলে দেন। দয়ারামের এহেন ব্যবহারে তিনি খুশী হয়ে কৃষ্ণজীর মূর্তি স্থাপনের জন্য দিঘাপতিয়ায় একখন্ড জমি কয়েকটি পরগণা দান করেন। নিঃসন্তান রামজীবন দেওয়ান দয়ারামের পরামর্শেই রামকান্তকে দত্তক গ্রহণ করেন এবং পুত্র রামকান্ত ও ভ্রাতুস্পুত্র দেবী প্রসাদের মধ্যে জমিদারী ভাগ করে নিতে চান। কিন্তু দেবী প্রসাদের একগুঁয়েমী মনোভাবের জন্য সমগ্র জমিদারী রামকান্তের নামে উইল করে দেন। রামকান্তের বিবাহের সময় তিনিই ছিলেন সর্বময় কর্তা। কন্যা পছন্দ, দিন-তারিখ নির্ধারণ, যৌতুক আদায়, আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ সব কিছুর ভারই অর্পিত ছিল দেওয়ান দয়ারামের উপর। রামজীবন মৃত্যকালে দয়ারাম রায়কেই পুত্রের একমাত্র অভিভাবক নিযুক্ত করে যান।
রামকান্ত বালক মাত্র, তাই রাজশাহীর মতো ব্যাপক ও বিস্তৃত জমিদারী পরিচালনা করা তার পক্ষে অসম্ভব। এজন্য প্রকৃত কর্তৃত্ব ছিল দযারাম রায়ের উপর। তাঁর সুদক্ষ ও নিপুণ পরিচালনায় জমিদারীর মর্যাদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। সরফরাজ খাঁনের সময় ১৩৯ পরগনার স্থলে রাজশাহী জমিদারী গরগণার সংখ্যা দাড়ায় ১৬৪ তে। রামকান্ত বয়ঃপ্রাপ্ত হলে স্বাধীনভাবে এবং স্বহস্তে জমিদারী পরিচালনার ইচ্ছা প্রকাশ করলে দয়ারাম রায় অবসর গ্রহণ করেন এবং দিঘাপতিয়ায় রাজবাড়ী নির্মাণ করতে থাকেন। যুবক রামকান্ত বিরাট জমিদারী, প্রচুর সম্পদ, সুন্দরী স্ত্রী, অশেষ মান-সম্মান লাভ করে সুখ-স্বাচ্ছন্দে ছিলেন। কিন্তু দয়ারাম রায়ের অবসর গ্রহণের পর কিছু অসাধু আমাত্যবর্গ দ্বারা পরিবেষ্ঠিত হন এবং বিভিন্ন প্রকার আমোদ-আহলাদে কালাতিপাত করতে থাকেন। পুন্যবতী স্ত্রী রাণী ভবানীর শত উপদেশ সত্ত্বেও যথারীতি রাজকার্য পরিচালনায় মনোনিবশে করতে পারেননি। ফলে নবাব সরকারের প্রচুর রাজস্ব বাকি থাকে। এ সময় দয়ারাম রাজকার্যে মনোনিবেশ এবং যথারীতি রাজস্ব প্রদান করতে উপদেশ দেন। নবাব আলিবর্দ্দী খাঁ জমিদারী দেবী প্রসাদকে অর্পন করলে অবশেষে দয়ারাম রায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং জগৎশেঠের সহযোগিতায় পুনরায় তা ফিরে পান। ১৭৪৮ সালে রাজা রামকান্তের মৃত্যু হলে দয়ারাম রায় রাণী ভবানীর পাশে থেকে জমিদারী পরিচালনা করেন। তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় রাণী বর্গীয় আক্রমণের সমস্যা কিছুই বুঝতে পারেননি। রাণী ভবানীর একমাত্র কন্যা তারার বিয়ের সময় তিনিই ছিলেন প্রধান কর্মকর্তা। জামাতা রঘুনাথের মৃত্যুর পর দয়ারামই তাকে দত্তক গ্রহণে সম্পূর্ণ সাহায্য করেন। রাণী ভবানী দয়ারাম ও তারা এ দু’জনের সাথে পরামর্শ করেই বিষয়কার্য পরিচালনা করতেন। রাণী ভবানী দয়ারামকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন এবং অনেক সময় নিজ নামে কার্য পরিচালনার সুযোগ দিতেন। দয়ারাম সে সময়ে রাণীর পরামর্শ ছাড়া বাহ্মণদের ব্রহ্মোত্তর দান করেন। এ বিষয়ে রাণী ভবানীর কোন আপত্তি ছিল না, কারণ তাঁর বিশ্বাস বৃদ্ধ মন্ত্রী দয়ারাম রায় নাটোর রাজের মঙ্গল ছাড়া কোন সময়ে অমঙ্গল কামনা করেন না। কিন্তু রাজকুমারী তারা দয়ারামের এ কাজটিকে সমর্থন করতে পারেননি। তাঁর মতে, রাজকর্মচারী অন্য কোন কাজ করলেও প্রকৃত মালিকের অনুমতি না নিয়ে ভূ-সম্পত্তি দান করতে পারেন না। তিনি দান অসিদ্ধ ঘোষনা করেন। দয়ারাম রায় এ সময়ে রাণী ভাবানীর সাথে সাক্ষাৎ করে সব কথা খুলে বলেন। প্রকাশ্য যে, ভবানীর বিবাহের সময় রামজীবনের পরিবর্তে দয়ারাম রায়ই বিবাহের কাগজে সহি করেন। দয়ারাম রায় সেই জীর্ণ কাগজটি রাণীর সামনে ধরে বলেন যে, যদি দয়ারামের স্বাক্ষরে ব্রহ্মোত্তর অসিদ্ধ হয়, তবে এ বিয়েও সিদ্ধ হয়নি। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে তারা সুন্দরী মনোভাব ত্যাগ করেন এবং দয়ারামের কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করেন। ১৭৬০ সালের দিকে রাণী ভবানী একবার রাজ্যচ্যুত হন। সে সময়ে দয়ারাম রায় কিছুদিনের জন্য জেল খাটেন বটে, কিন্তু রাণী ভবানীকে রাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে তবেই তিনি ক্ষান্ত হন। নাটোর রাজের গগণস্পর্শী উত্থানে দেওয়ান দয়ারাম রায়ের অবদান অনস্বীকার্য। কখনও তিনি সেনানায়ক রূপে শক্ত হাতে অশি পরিচালনা করেছেন, কখনও বিদ্ব্যান ব্যক্তির মত কলম হাতে নিয়ে জমিদারীর হিসাব রেখেছেন। কখনও ভূষণায়, কখনও ভাতুরিয়ায়, কখনও বড়নগর-মুর্শিদাবাদে ছুটাছুটি করেছেন। রঘুনন্দন নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন সত্য কিন্তু দেওয়ান দয়ারমের সুদক্ষ পরিচালনার জন্য উক্ত রাজবংশ তৎকালে এত খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছিলেন।
লর্ড ক্লাইভ এদেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন সত্য কিন্তু লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস সে শাসন ব্যবস্থাকে স্থায়িত্ব দেন। কিশোরী চন্দ্র মিত্র রঘুনন্দনকে নাটোর রাজের ‘‘ক্লাইভ’’ এবং দয়ারামকে ‘‘ওয়ারেন হেস্টিংস’’ বলে অভিহিত করেছেন। নাটোর রাজের উত্থান ও শ্রীবৃদ্ধিতে দেওয়ান দয়ারাম রায়ের যে অশেষ অবদান ছিল সেকথা স্বীকার করে মৃত্যুর ২শত বছর পরেও উক্ত রাজবংশের মহারাজা শ্রী যোগীন্দ্রনাথ দৃঢ়কন্ঠে বলেছেন, ‘‘রাই রাইয়া দয়ারাম রায় নাটোর রাজবংশের কতখানি আপন জন ছিলেন সেকথা জানিতেন দয়ারাম, জানিতেন তৎকালীন নাটোরাধিপাতিগণ এবং জানে বাংলার ইতিহাস। তাঁহার কথা লিখিতে গেলে বহুশত পৃষ্ঠা লিখিলেও তাঁহার অদ্ভুত ও অপূর্ব গুণরাজি সম্পূর্ণ আলোচনা করা সম্ভব হইবে না’’
১৭৬০ সালে ৮০ বছর বয়সে তিনি ৫ কন্যা, ১ পুত্র ও প্রচুর সম্পদ রেখে ইহলীলা ত্যাগ করেন। দেওয়ান দয়ারাম রায়ই প্রথমে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী নির্মাণ করেন যা এখন উত্তরা গণভবন নামে খ্যাত।
দিঘাপতিয়া রাজা প্রমথনাথ রায়ের (১৮৪৯-১৮৮৩) জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রমদানাথ রায় ১৮৯৪ সালে দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর তার তিন কনিষ্ঠ ভ্রাতা কুমার বসন্ত কুমার রায়, কুমার শরৎকুমার রায় এবং কুমার হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জন্য বড়াল নদীর তীরে নন্দীকুজা নামক স্থানে ‘‘দিঘাপতিয়া জুনিয়র রাজ দয়ারামপুর এস্টেটস’’ স্থাপন করেন। তাদের প্রপিতামহের পিতাসহ নাটোরের রাণী ভবানীর অসাধারণ দক্ষ দেওয়ান ও দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দয়ারামপুরের নামানুসারে এই এলাকার নাম হয় দয়ারামপুর, আর বাড়ীর নাম হয় ‘‘দয়ারামপুর জমিদারবাড়ী’’। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদান রাখায় পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে শহীদ লেঃ কর্ণেল আব্দুল কাদিরের নামে এই জায়গায় কাদিরাবাদ সেনানিবাস স্থাপিত হয়।
কিভাবে যাওয়া যায়:
নাটোর শহর থেকে অটো বা বাসযোগে দয়ারামপুর রাজবাড়ি যাওয়া যায়। অটো রিসার্ভ করলে ভাড়া- ১৫০ টাকা ।