তাল
তাল
(Palmyra palm)
উদ্ভিদতাত্ত্বিক
নাম : Borassus flabellifer
ভূমিকা
: তাল একটি অতি প্রাচীন অপ্রচতি ফল । ইহা Palmae
পরিবারভুক্ত। ইহার
গাছ একক কান্ড বিশিষ্ট এদেশে অতি পরিচিত একটি বৃৰ। এর
কান্ড সোজা ও এবং চমৎকার আকৃতির পাতাগুলো পাখার মত গোলাকার । পত্র
চর্মের ন্যায় শক্ত। উহার
অনেক উচু শিরা আছে। শিরাগুলো
পত্রদন্ডের গোড়া হতে অগ্রভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত, পত্রের কিনারা কাঁটার মত। পত্রদন্ডের
উভয় কিনারায় করাতের মত কালবর্ণের দাঁত আছে। ইহা
একটি ভিন্নবাসী উদ্ভিদ, পুর্বষ ও স্ত্রী ফুল আলাদা গাছে উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশের
সব এলাকায় কমবেশী তাল উৎপাদন হলেও ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, রাজশাহী ও খুলনা এলাকায় সবচেয়ে বেশী উৎপাদন হয়।
উৎপত্তিস্থান
:
তালের
জন্মস্থান মধ্য আফ্রিকা বলে ধারণা হলেও অনেকে বলেন এটি আমাদের উপ-মহাদেশীয় বৃক্ষ।
পুষ্টিমান
:
পাকা
তালের খাদো্যপযোগী প্রতি ১০০ গ্রামে জলীয় অংশ ৭৭.২ গ্রাম খনিজ০.৭ গ্রাম, আঁশ ০.৫ গ্রাম, আমিষ ০.৭ গ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম শর্করা ২০.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৯ মিলিগ্রাম ও খাদ্য শাক্তি ৮৭ কিলোক্যালরী রয়েছে।
ওষুধিগুণ
:
তালের
রস শেৱষ্মানাশক।এটি
মূত্র কর , প্রদাহ ও কোষ্ঠাঠিন্য নিবারণ করে। রস
থেকে তৈরি তালমিসরি সর্দি কাশির মহৌষধ, যকৃতের দোষ নিবারক ও পিত্তনাশক।
জাত
:
তালের
কোন অনুমেদিত জাত নেই। তবে
এদেশে বিভিন্ন আকার ও রংয়ের তাল দেখা যায়। আবার
কোন কোন তাল গাছের বারমাসই কমবেশী তাল ধরে থাকে।
উৎপাদন
পদ্ধতি :
জমি
নির্বাচন ও তৈরী :
প্রায়
সব ধরনের মাটিতেই তাল ফসলের আবাদ করা যায়। তবে
উঁচুজমিতে এবং ভারী মাটি ইহা চাষের জন্য বেশী উপযোগী। এদেশে
বাগান আকারে কোন তাল ফসলের আবাদ নেই। বাগান
আকারে চাষ করতে হলে নির্বাচিত জমি ভাল করে চাষ ও মই দিয়ে জমি সমতল এবং আগাছা মুক্ত করে নিতে হবে।
বীজ
সংগ্রহ ও নির্বাচন :
আগষ্ট
মাস থেকে তাল পাকতে শুর্ব করে এবং অক্টোবর মাস পর্যন্ত পাকা তাল পাওয়া যায়। তাল
বীজ সংগ্রহ করে নির্বাচন করা উত্তম। তবে
উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নির্বাচিত মাতৃবৃৰ হতে তালের বীজ সংগ্রহ করা উচিত।
বীজ
বপনের সময় :
ভাদ্র
হতে কার্তিক মাস বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
বীজ
বপনের দূরত্ব :
সারি
থেকে সারি ৭ মিটার এবং চাবা থেকে চারা ৭ মিটার
গর্ততৈরী
ও প্রাথমিক সার প্রয়োগ:
গর্তের
আকার হবে ১ মিটার চওড়া ও ১ মিটার গভীর। গর্ত
করার ১০-১৫ দিন পর প্রতি গর্তে ১৫-২০ কেজি জৈব সার, ২৫০ গ্রাম টি এস পি এবং ২০০ গ্রাম এমপি মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে।
বংশ
বিস্তার :
বীজের
মাধ্যমে তালের বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। দুই
ভাবে তাল গাছ লাগানো যায়। একটি
পদ্বতি হলো সরাসরি বীজ
বপন করে অথবা
বীজতলায় চারা উৎপাদন করে চারা রোপনের মাধ্যমে এর
আবাদ করা যায়।
বীজ
বপন:
সমতল
ভূমিতে তালের বীজ সাধারনত বর্গাকার বা ষড়ভূজী প্রণালীতে লাগানো যেতে পারে। তাবে
উচু নিচু পাহাড়ী এলাকায় কন্টুর প্রনালী করা যেতে পারে। গর্ত
ভর্তি করার ১০-১৫ দিন পর গর্তের মাঝখানে বীজ বপন করতে হবে।
বীজতলা
তৈরী ও চারা উৎপাদন :
পাকা
অথবা ইট হিছানো মেঝেতে বীজতলা তৈরী করতে হবে। মাটির
উপরও বীজতলা তৈরী করা যেতে
পারে। এৰেত্রে
চারার শিকড় যাতে বীজতলার তৈরী মাটিতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য প্রথমেই পলিথিন শীট বিছিয়ে দিতে হবে। এরপর
৩০-৪০ সে.মি: পুর্ব বেলে মাটি অথবা কম্পোষ্ট দিয়ে বীজতলা তৈরী করতে হবে। বীজতলার
আকার হবে ১ মিটার প্রস্থ ও ১০ মিটার অথবা জমির সাইজ অনুযায়ী দৈর্ঘ্য হতে পারে । এ
আকারের একটি বীজতলা প্রায়১০০০ টি বীজবপন করা যায়। সংগ্রহিত
বীজ পাশাপাশি রেখে বীজতলার উপর সাজাতে হবে এবং বীজের উপর ২-৩ সে. মি: বালি অথবা কম্পোষ্ট দিয়ে বীজ ঢেকে দিতে হবে।
বীজতলা
সবসময় ভিজিয়ে রাখতে হবে। ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যেই বীজ অংকুরিত হতে শুর্ব করবে। বীজ
অংকুরোদগমের সময় বীজপত্রের যে আবরণী বের হয়ে আসে তা দেখতে শিকড়ের মত কিন্তু আসলে তা শিকড় নয়।
এই বীজপত্রের আবরণীর মাঝে ফাঁপা থাকে, অগ্রভাগে ভ্রূণ অবস্থান করে এবং টিউবের আকৃতিতে বৃদ্ধি পায়। হলদে
রং-এর জার্মটিউবের অগ্রভাগে ভ্রূণ আবৃত থাকে এবং তা সাধারণত মাটির নীচের দিকে বৃদ্ধি পায়।
জার্মটিউবলন্ব
হবার পরেই
ভ্রূণের Coleoptile (åƒY কান্ডের আবরণী)
এবং Coleorhiza
(ভ্রূণ
মূলের আবরণী)-এর বৃদ্ধি শুর্ব হয়। জার্মটিউবের
মতো Coleoptile ১৫-৪০ সে. মি. লন্ব হয়ে থাকে । Coleorhiza ও শিকড় এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যে এদের পৃথক করা কঠিন এবং বীজতলার নিচের মেঝেতে বাধা প্রাপ্ত হয়ে বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। জার্মটিউব
লন্ব হবার ১০-১৫ সপ্তাহের মধ্যে Coleoptile এর উপরে একটি পাতলা আবরণীতে পরিণত হয়। এঅবস্থায়
চারায় কেবল ১ টি Coleoptile ও
১টি শিকড় থাকে। চারার
গোড়া ও শিকড়ের গা হতে ছোট ছোট অনু শিকড়ও গজাতে শুর্ব করে। Coleoptile এর বৃদ্ধি সম্পূর্ণ হলে বীজের সাথে জার্মটিউবের সংযোগ স্থানে পচতে/ শুকাতে আরম্ভ করলে চারা পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে।
চারা
পলিব্যাগে স্থানান্তর ও নার্সারীতে পরিচর্য্যা :
বীজতলার
উৎপাদিত চারা গোরব মিশ্রিত মাটি দিয়ে ভরা 15x15 সে. মি. আকারের পলিব্যাগে স্থানান্তর করতে হবে। ব্যাগের
পূর্বত্ব হবে ০.০৬/০.০৭ মিমি। প্রতিটি
পলিব্যাগের নীচের দিকে চার জোড়া ছিদ্র রাখতে হবে। ব্যাগে
ভরার জন্য ১/৫ অংশ গোবর ও ৪/৫ অংশ মাটির মিশ্রিণ ব্যবহার করতে হবে। প্রথমে
বীজতলা খনন করে বেলেমাটি
/ কম্পোস্ট সরিয়ে চারা উন্মুক্ত করতে হবে। বীজ
থেকে চারা আলাদা করার জন্য জার্মটিউবের উপরে অর্থাৎ বীজ সংলগ্ন চিকন, পচা / শুকনো স্থানে
কাটতে হবে। যদি
চারার শিকড় বেশি লন্ব হয় তাহলে ১০-১৫ সে. মি. শিকড় রেখে বাকি অংশ ধারালো চাকু দিয়ে কেটে ফেলতে হবে।
প্রথমত
:
পলিব্যাগের
১/৩ অংশ গোবর মিশ্রিত মাটি ভরতে হবে। এরপর
চারাটি পলিব্যাগের মাঝামাঝি এমনভাবে রাখতে হবে যেন চারার গোড়া প্রায় ৫ সে.মি. ব্যাগের মধ্যে থাকে। অত:পর গোবর মিশ্রিত মাটি দিয়ে ব্যাগের বাকী অংশ ভরতে হবে (চিত্র-১)। পলিব্যাগে
চারা স্থানান্তরের পরে অন্তত: ২-৩ সপ্তাহ আংশিক ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং নার্সারিতে সাজিয়ে রাখতে হবে।
পানি দিয়ে পলিব্যাগের মাটি আর্দ্র রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। পলিব্যাগের
চারা সবসময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে এবং রোগবালাই দমন করতে হবে।
মাঠে
চারা রোপন:
মৌসুমী
বৃষ্টিপাত আরম্ভ হওয়ার পরপরই পলিব্যাগে উত্তোলিত ৩০-৩৫ সে. মি. লন্ব পাতা বিশিষ্ট চারা মাঠে রোপন করা উচিত। তবে
মাটিতে প্রচুর পরিমাণে আর্দ্রতা থাকলে অথবা পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে চারা এপ্রিল- মে মাস পর্যন্ত লাগানো যেতে পারে।সমতল
ভূমিতে অন্যান্য বৃৰ প্রজাতির পলিব্যাগের চারার মতোইএ চারা লাগাতে হবে। চারা
লাগানোর নির্দিষ্ট স্থানে পলিব্যাগের আকৃতি অনুসারে অগার দিয়ে গর্ত করে পলিথিন
ছিড়ে পলিব্যাগের মাটিসহ চারা গর্তে বসাতে হবে। গুড়ো
মাটি দিয়ে গর্তের ফাঁক ভরাটসহ ভালভাবে চারার গোড়ার মাটি চেপে দিতে হবে। চারাগুলো
আগাছমুক্ত রাখা ও গবাদি পশুর উপদ্রব থেবে রৰার ব্যবস্থা দিতে হবে। চারা
রোপণের পর অন্তত প্রথম তিন বছর রোগ- বালাই ও কীট -পতঙ্গের আক্রমণের হাত
হতে চারা রৰা করা আবশ্যাক।
সার
প্রয়োগ :
প্রতি
বছরই বর্ষার
আগে ও পরে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছের
বয়স বাড়ার সাথে প্রতি বছর সারের মাত্রা ১০% হারে বাড়িয়ে দিতে হবে। পূর্ণবয়স্ক
গাছে প্রতিবছর ১৫-২০ কেজি গোবর,ইউরিয়া ১ কেজি, টি এসপি ৫০০ গ্রাম, এমপি ৫০০ গ্রাম সার প্রয়োগ করতে হবে। সার
প্রয়োগের পর পরই পানি সেচ দিতে হবে।
পরিচর্য্যা
:
সার
প্রয়োগ ছাড়াও আগাছা পরিস্কার , সেচ ও নিস্কাশনের প্রতি গুর্বত্ব দিতে হবে। নিয়মিত
যত্ন ও পরিচর্য্যা নিশ্চিত করা হলে ১০- ১২ বছরের মধ্যেই তাল খাওয়া যায়।
পোকা
মাকড় ও রোগবালাই :
তাল
গাছে কোন পোকামাকড়- ও রোগবালাই দেখা যায় না ।
ফল
সংগ্রহ:
মধ্য
পৌষ থেকে মধ্য চৈত্র (জানুয়ারি থেকে মার্চ) মাসে ফুল আসে এবং শ্রাবণ- ভাদ্র মাসে ফল পাকতে শুরু করে। প্রতি
গাছে প্রায় ১৫০- ২৫০ টি ফল
ধরে। তালের
ব্যবহার তালের রস বিভিন্ন প্রকার পিঠা
, মিছরি ও গুড় তৈরীতে ব্যবহার হয়। সদ্য
আহরিত তালের রস পানীয়।
তালগাছের পাতা ও আঁশ পাখা ও অন্যান্য কুটির শিল্পজাত দ্রব্য তৈরীর জন্য ব্যবহার করা যায়। বয়স্ক
তালগাছ থেকে উৎকৃষ্ট মানের কাঠ পাওয়া যায় যা গৃহ নির্মান ও সৌখিন দ্রব্য প্রস্তুত করা জন্য ব্যবহার করা হয়। পাকা
তালের রস কনফেকশনারীতে
শুকনো খাবার প্রস্তুত করনের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়।