নেপিয়ার ঘাস চাষ পদ্ধতি
নেপিয়ার ঘাস
দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথমেই জাতের উন্নয়ন আবশ্যক। তারপরই
আসে
খাদ্যের ভূমিকা। খাদ্যের
মধ্যে কাঁচা ঘাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুধ উৎপাদন
বৃদ্ধিতে কাঁচা ঘাসের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ
জনসংখ্যায় খুবই ঘন বসতিপূর্ণ। জমির
পরিমাণ অল্প। তাই যেখানে
মানুষের খাদ্য উৎপাদনেই নাভিশ্বাস উঠছে, সেখানে গবাদির জন্য খাদ্য উৎপাদন অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে। তবুও
যদি
কৃষকভাইরা দেখেন যে ঘাস উৎপাদনের ফলে তাঁদের গাভীর দুধ উৎপাদন বাড়ছে এবং এর লভ্যাংশ দ্বারা অন্যান্য খরচ মেটানো সম্ভব, তাহলে তাঁরা গবাদিপশু পালনের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। আর কাঁচা
ঘাস
সহজ
প্রাপ্য হলে গাভী পালনও সহজতর হবে। তাই আধুনিক
পদ্ধতিতে ঘাস চাষ করতে হবে। সেজন্য
দরকার ব্যাপকভাবে উচ্চ উৎপাদশীল ঘাস চাষ। কাজেই
এ
বিষয়ে কৃষক ভাইদের সচেতন করতে হবে।
আমরা আজকে এমনই একটি ঘাস চাষ নিয়ে আলোচনা করবো যার উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বেশি। বাংলাদেশের
প্রায় সকল এলাকায় এ ঘাস জন্মানো সম্ভব এবং তা থেকে প্রায় সারা বছরই গবাদির কাঁচা ঘাসের চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। এই ঘাসটির
নাম
নেপিয়ার।
নেপিয়ার এক প্রকার স্থায়ী ঘাস। দেখতে
আখের
মত,
লম্বা ৬.৫-১৩.০ ফুট বা তার চেয়েও বেশি হয়ে থাকে। এই ঘাস দ্রুত
বধর্নশীল, সহজে জন্মে, পুষ্টিকর, সহজপাচ্য ও খরা সহিষ্ণু। একবার
রোপন
করলে
৩/৪ বছর পর্যন্ত
এর
ফলন
পাওয়া যায়। শীতকালের
২/৩ মাস ছাড়া
প্রায় সারা বছরই এর উৎপাদন অব্যাহত থাকে। এই ঘাস আবাদের
জন্য
উঁচু
ও
ঢালু
জমি
যেমন
বাড়ির পার্শ্বে উঁচু অনাবাদি জমি, পুকুরের পাড়, রাস্তার ধার ও বেড়ীবাঁধ সবচেয়ে উত্তম। ডোবা,
জলভূমি কিংবা প্লাবিত হয় এমন অঞ্চলে এই ঘাস আবাদ করা যায় না।
জমি নির্বাচনঃ
পানি নিষ্কাশনের জন্য ভাল ব্যবস্থা আছে অর্থাৎ যেখানে বৃষ্টি বা বর্ষার পানি জমে থাকে না এরূপ জমি নেপিয়ার চাষের জন্য উত্তম। প্রায়
সব
ধরনের মাটিতেই এ ঘাস রোপন করা যায়, তবে বেলে-দোআঁশ মাটি সবচেয়ে বেশি উপযোগী।
চাষের সময়ঃ
নেপিয়ার ঘাস সারা বৎসরই রোপন করা যায়। সাধারণতঃ
বর্ষা মৌসুমেই রোপন করা ভাল। বর্ষার
প্রারম্ভে এই ঘাসের কাটিং বা চারা রোপন করা হয়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ
মাসে
প্রথম বৃষ্টির পর জমিতে চারা বা কাটিং লাগালে প্রথম বছরেই ৩/৪ বার পর্যন্ত ঘাস কাটা যেতে পারে। চারা
বা
কাটিং লাগানোর পর যদি রৌদ্র হয় বা মাটিতে রস কম থাকে তাহলে চারার গোড়ায় পানি সেচ দিতে হবে।
জমিচাষ ও রোপন পদ্ধতিঃ
সমতল জমিতে ৪/৫টি চাষ ও মই দিয়ে জমি আগাছামুক্ত করে কাটিং বা চারা লাগাতে হবে। এই ঘাস আখের
কাটিং-এর মত কাটিং অর্থাৎ কান্ডের দুই মাথায় কমপক্ষে দু'টি বা তিনটি গিট রেখে কাটতে হবে। এক সারি
হতে
অন্য
সারির দূরত্ব ৩৬ ইঞ্চি এবং এক চারা হতে অন্য চারার দূরত্ব ১৮ ইঞ্চি। কাটিং
৬-৮ ইঞ্চি
গভীরে রোপন করা উচিত। একটি
গিট
মাটির নীচে, মধ্যের গিট মাটির সমানে রেখে চারা বা কাটিং অনুমানিক ৪৫০ কৌণিকভাবে লাগাতে হয়। সাধারণত
জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর অথবা ভাদ্র মাসের শেষ ভাগে যখন বৃষ্টিপাত কম থাকে তখন নেপিয়ার ঘাস লাগানো উত্তম। অতি বৃষ্টিতে
কাটিং লাগালে তা পচে যাবার সম্ভাবনা থাকে। মোথা
লাগালে অনুরূপভাবে জমি তৈরি করে নির্দিষ্ট দূরত্বে গর্ত করে গর্তের মধ্যে একটি করে চারা লাগাতে হবে। সম্ভব
হলে
প্রতি গর্তে কিছু পচা গোবর বা মুরগীর বিষ্ঠা দেয়া উত্তম।
রাস্তা, পুকুরের বাঁধ বা পাহাড়ের ঢালু জমিতে নেপিয়ার চাষ করতে হলে প্রথমে ঢালের আগাছা কোদাল বা কাচি দ্বারা কেটে পরিষ্কার করতে হবে। এরপর
নির্দিষ্ট দুরত্বে কোদাল দিয়ে ছোট ছোট গর্ত করে প্রতি গর্তে গোবর বা মুরগীর বিষ্ঠা এবং টিএসপি সার দিয়ে চারা লাগাতে হবে। চারা
লাগিয়ে চার পাশ ভাল করে মাটি দিয়ে চেপে দিতে হবে যাতে চারার শিকড় মাটির সাথে লেগে থাকে।
সার ও পানি সেচ পদ্ধতিঃ
উন্নত জাতের ঘাসের ফলন বেশি পেতে হলে জমিতে প্রয়োজন অনুসারে সার দিতে হয়। জমির
গুণাগুণের উপর নির্ভর করে সার ও পানি সেচ দিতে হবে। বাংলাদেশে
বর্ষার সময় ৫/৭ মাস পানি সেচের প্রয়োজন হয় না, শুধু খরার সময় পানির সেচের প্রয়োজন হয়। পচা গোবর
ও
ফার্মজাত আবর্জনা, পচানো ঘাস হেক্টর প্রতি প্রায় ৩০০০/৪০০০ কেজি জমি চাষের সময় ভালভাবে ছিটিয়ে দিলে মাটিতে পুরোপুরি মিশে যায়। বেশি
ফলন
পেতে
হলে
এর
সাথে
হেক্টর প্রতি ২২৫ কেজি ইউরিয়া, ১৫০ কেজি টিএসপি এবং ৭৫ কেজি মিউরেট অব পটাশ প্রয়োগ করতে হবে। চারা
রোপনের পর জমিতে চারা লেগে গেলে অর্থাৎ রোপনের প্রায় ১০/১২ দিন পর হেক্টর প্রতি ৮০ কেজি ইউরিয়া সার দিলে ভাল হয়। প্রত্যেক
কাটিং-এর পর দুই সারির মাঝের জমি ভালভাবে লাঙ্গল বা কোদাল দিয়ে মাটি আলগা করে হেক্টর প্রতি ৫০ কেজি ইউরিয়া সার দিলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। প্রথম
কাটিং ৬০-৮০ দিনের মধ্যে পাওয়া যায়। বর্ষাকালে
নেপিয়ারের উৎপাদন ভাল হয়। বৎসরে
কমপক্ষে দু'বার (আষাঢ়-শ্রাবণ ও মাঘ-ফাল্গুন মাসে মাটি আলগা করে দিতে হবে। গ্রীষ্মকালে
১০-১২ দিন বিরতিতে
এবং
শীতকালে ১৫-২০ দিন বিরতিতে পানি সেচ দিলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়।