গোরক্ষনাথ
মন্দির - ঠাকুরগাঁও জেলা
নেকমরদ
থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে ঠাকুরগাঁওয়ের আরো একটি ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থান হলো গোরকই বা গোরকুই। আর
এখানেই রয়েছে বিখ্যাত গোরক্ষনাথ মন্দির ও নাথ আশ্রম। কোনো
কোনো ঐতিহাসিক গোরক্ষনাথকে নাথপন্থীদের ধর্মীয় নেতা মীননাথের শিষ্য বলে ধারণা করে থাকেন। গবেষকদের
মতে, এই গোরক্ষনাথ কোনো ব্যক্তি বিশেষের নাম নয়, গোরক্ষনাথ হলো নাথপন্থি সম্প্রদায়ের গুরু বা যোগীর উপাধি মাত্র। কেননা
উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিম কামরূপসহ
ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে গোরক্ষনাথের নাম পাওয়া যায়। এছাড়া
নেপালেও বৌদ্ধযোগী হিসেবে একজন গোরক্ষনাথের অস্তিত্বের কথা ইতিহাসে উল্লেখ আছে।
কোচবিহার
রাজ সরকারের অনুমতিক্রমে খাঁ চৌধুরী আমানতউল্লাহ আহমদ কর্তৃক সংকলিত ‘‘কোচবিহারের ইতিহাস, প্রথম খন্ড’’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, ‘‘গোরক্ষনাথ কোন ব্যক্তি বিশেষের নাম না হইয়া নাথপন্থি সম্প্রদায়ের কোন গুরু বা যোগি বিশেষের একটি উপাধি হওয়াই অধিকতর সঙ্গত বলিয়া অনুমতি হয়।’’ কিন্তু
গোরক্ষনাথ যে ধর্মীয় উপাধি মাত্র এই যুক্তি অনেক পন্ডিত মেনে নেননি। নাথ
উপাধি হতে পারে, কিন্তু পুরো গোরক্ষনাথই উপাধি নয়। গোরক্ষনাথ
যে একজন ব্যক্তি তাতে বোধহয় কোনো সন্দেহ নেই। ‘মহাযানী’
বৌদ্ধধর্ম পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের মধ্যে বিলীন হওয়ার পর যে সহজিয়া ধর্মমতের উদ্ভব হয় তার সঙ্গে হিন্দু যোগবাদের সংমিশ্রণের ফলে এই নাথধর্মের সৃষ্টি। গুপি
চন্দ্রের সন্ন্যাস গ্রন্থে নাথধর্ম প্রসঙ্গে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বলেছেন; ‘‘বাঙলাদেশে বৌদ্ধধর্মের ক্রমবিবর্তনের ফলে এক নতুন ধর্মের পত্তন হয় এবং সেটাই হচ্ছে মীননাথ প্রবর্তিত নাথ ধর্ম।’’ নাথপন্থিদের
ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে, ‘‘প্রাচীন নাথপন্থিগণের মতে মহাপ্রলয়ের শেষে একমাত্র ‘অলেখ নিরঞ্জন’ই অবশিষ্ট থাকেন
এবং সিদ্ধ নাথগুরুগণ নিরঞ্জনের স্বরূপ বলিয়া কথিত হন’’ বর্তমানে নাথপন্থি সম্প্রদায়ের আলাদা অস্তিত্ব নেই। নাথ
উপাধিধারী ব্যক্তিরা হিন্দু সমাজভুক্ত হয়ে কোনো প্রকারে তাদের প্রাচীন স্মৃতি রক্ষা করছে।
এই
নাথপন্থি ধর্ম সম্প্রদায়ের গুরু গোরক্ষনাথের স্মৃতিবাহী গোরক্ষনাথ মন্দির ও আশ্রমটি রাণীশংকৈলের
গোরকুইয়ের একটি মৃত নদীর তীরে উঁচু জমির উপর অবস্থিত। মন্দির
চত্বরটিতে মোট ৫টি মন্দির রয়েছে। ৩টি
শিব মন্দির ও ১টি কালিমন্দির
ছাড়াও ১টি প্রধান মন্দির আছে যা নাথ মন্দির নামে পরিচিত। এই
নাথমন্দিরটি দক্ষিণমুখিভাবে চত্বরের প্রায় মধ্যস্থলে অবস্থিত। এর
পেছনে অর্থাৎ উত্তর দিকে পাষাণ বাঁধানো একটি চৌবাচ্চার মতো নিচু স্থানের মধ্যস্থলে বড় বড় কালো পাথরের খন্ড দিয়ে ঘেরা এক অলৌকিক ইদাঁরা বা কুয়ো আছে। কুয়োর
একেবারে নিচু অংশটুকুও পাথর দিয়ে বাঁধানো। কিন্তু
মাঝে একটি ছিদ্র আছে যা দিয়ে নিচ থেকে কুয়োতে পানি আসে। কুয়োর
চারপাশে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে অনেক লোক পূণ্যস্নান করলেও কুয়োর পানি কমেনা। মন্দিরের
উত্তর চত্বরে টিনের চাল বিশিষ্ট যে আশ্রম রয়েছে তার দরজায় একটি শিলালিপি বা ফলক ছিল। এই
শিলালিপিটি বর্তমানে দিনাজপুর যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এর
সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার করা সম্ভব না হলেও বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক আবু তালিবের মতে, এই শিলালিপিটি বাংলা অক্ষরে উৎকীর্ণ এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত
শিলালিপি গুলোর মধ্যে প্রাচীনতম।