পুরাতাত্ত্বিক
নিদর্শন বা প্রাচীন সভ্যতার নমুনা বাংলাদেশেও আছে। তবে এতোদিন আমাদের সভ্যতা কতোটা
প্রাচীন এ প্রশ্ন উঠলেই উল্লেখ করা হতো মহাস্থানগড় ও লালমাই পাহাড়ের বৌদ্ধ সভ্যতার
বিষয়। এর বাইরে গর্ব করে বলার মত সভ্যতার তেমন কোন নিদর্শন ছিল না বলা চলে। কিন্তু
এখন সে অবস্থা নেই, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দমদম পীরের ঢিবি ও ওয়ারী বটেশ্বর প্রভৃতি।
এগুলো পাল্টে দিয়েছে আমাদের দেশের সভ্যতার প্রাচীনত্বের ধারণা।
যশোর সদর
থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মনিরামপুর। খুব সমৃদ্ধ না হলেও বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ডে
একেবারে পিছু পড়া এলাকা বলা ঠিক হবে না। এ উপজেলার ডোগাগাতি ইউনিয়নের সোনার গ্রাম নামক
স্থানে দম দম পীরের ঢিবি।
এক সময় ঢিবিটি
সেন বা সুলতানী আমলের বলে ধারণা করা হতো। কিন্তু কিছুটা খনন করার পর সে ধারণা পাল্টে
গেছে। এখন আর একে কেউ তিন-চারশ বছরের প্রাচীন বলে মনে করে না। স্থানীয় লোকজনসহ বিশেষজ্ঞদের
ধারণা প্রাচীনত্বে এটি লালমাই পাহাড়ের বৌদ্ধবিহার সভ্যতার সম-সাময়িক, এমনকি আরও কিছু
প্রাচীন হতে পারে।
লালমাই সভ্যতা
ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দির। সে হিসাবে তের চৌদ্দশ বছরের প্রাচীন। দমদম পীরের ঢিবিকে স্থানীয়
লোকজন ছাড়াও পুরাতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন ১৮শ বছরের প্রাচীন। এখানে যে
সব জিনিসপত্র পাওয়া গেছে এর মাঝে ছোট আকারের পাথরের তৈরী বুদ্ধমূর্তি, ছয়টি কক্ষ, পোড়ামাটির
ফলক ও পদ্মফুল, ধাতব আংটি, হাড়ি, চুড়ি, কড়াই প্রভৃতি প্রধান। কক্ষগুলোর দেয়াল জ্যামিতিক
নকশার তৈরী। সিঁড়ির কারুকাজও প্রায় একরকম। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, প্রথমে এখানে ছিল
বৌদ্ধদেব বাস। এর পর আসে হিন্দু এবং সব শেষে মুসলমান। হয়তো ধর্ম প্রচারে এসে তৈরী
করা হয় পীরের আস্তানা। সে যাই হোক, এখানে, ছড়িয়ে আছে তিনটি সভ্যতার নিদর্শন।
'দমদম' নামকরণ
সম্পর্কে জানা যায় যে, উঁচু ঢিবির উপর হাঁটা চলার সময় দমদম আওয়াজ হতো। তাই এ নামকরণ
করা হয়। কেন এমন শব্দ হতো এ সম্পর্কে অবশ্য এলাকার কেউ নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারেননি।
যা বলা হয়ে থাকে তা অনেকটা রূপকথার মত শোনায়।
গ্রামের প্রবীন
ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দমদম পীরের ঢিবি থেকে কিছু দক্ষিণে মঙ্গল শাহ নামে
এক পীরের আস্তানা ছিল। এলাকার মানুষ এক সময় এখানে তাদের নানা রোগের জন্য টাকা, মুরগী
ও ছাগল মানত করতো। রোগ মুক্তির পর ওই স্থানে মানত করা পশু পাখি জবাই করে মিলাদ মাহফিল
করতো। এখনও হয় তবে আগের তুলনায় অনেকটা কম। এটা কবে থেকে চলে আসছে তা কেউ জানে না।
১৯৮৬ সালে
এলাকার মানুষ টিবি সংলগ্ন এটি মাদ্রাসা স্থাপন করে। মাদ্রাসা নির্মাণকালে টিবি থেকে
মাটি কাটার সময় ইটের তৈরী গাথুনী বেরিয়ে পড়ে। এঘটনা এলাকায় ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি
করে। দীর্ঘকাল মাটির নিচে পড়ে থাকা ঘর দেখতে বিভিন্ন স্থান হতে হাজার হাজার মানুষ ছুটে
যায় সেখানে। দমদম পীরস্থানের পরিচিতি ক্রমশ বিস্তার লাভ করতে থাকে।
২০০৪-০৫ সালে
সরকারীভাবে প্রথম খনন করা হয় এই ঢিবি। খননকালে ছাদ বিহীন ৮টি পূর্নাঙ্গ কক্ষ আবিষ্কৃত
হয়। ২০০৬-০৭ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মোট কক্ষ পাওয়া যায় ১৮টি। এই সময় মন্দিরের নকশার
মধ্যে পদ্মপাপড়ি খচিত ইট থেকে ধারনা করা হয় এটা জৈন মন্দির ছিল। যার স্থাপনাকাল ১০০
খৃষ্টপূর্বে।
পোড়াপাটির
সাপির ফনাযুক্ত পাত্র থেকে ধারনা করা হয় এখানে পঞ্চনাগ বা সপ্তনাগের অর্চনা হত যা জৈন
ধর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত, তাছাড়া ১৩ তম জৈন তীর্থ মল্লিনাথের বিগ্রহ জৈনধর্মকে সমর্থন
দেয়।
পাশেই একটি
পুকুর আছে। একে ঘিরে পুরান কিছু গল্প বিদ্যমান -হাড়ি ভেসে আসা, রাতে কেউ ডাকে, মানুষ
বলি দেয়া ইত্যাদি। অদ্ভুদ অদ্ভুদ গল্পের মধ্যে আরও রয়েছে- পুকুরে পানির মধ্যে কিছু
গাছ ছিল, সকল রোগের ঔষুধ হিসেবে ব্যাবহারযোগ্য-নাম- অচীন বৃক্ষ। এখন মাত্র ৩ টি গাছ
বেচে আছে। কিন্তু সেই গাছের আর ক্ষমতা আর নাই।
দীঘির পাড়ে
একটি কুয়া আছে। এ নিয়ে গল্প আছে যে, এই এলাকার কোন বাড়ীতে অনুষ্ঠান হলে কুয়ার কাছে
এসে কুমারী মেয়েরা যদি বলতো যে ‘আমাদের বাড়ীতে অনুষ্ঠান’,
তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়ার পাড়ে সোনার তালা, চামস, গামলা পাওয়া যেত। ব্যবহার শেষে
এখানে সেগুলো রেখে দিলে আবার অদৃশ্য হয়ে যেতো। তাই এই দিঘির নামকারণ করা হয় কুমারীদিঘি।
এই দিঘির
পাশে যে কূয়া আছে তার খুব কাছেই নাম না জানা ৭টি ফুল গাছ ছিলো। কিংবদন্তী আছে যে, সেই
১৮’শ বছর আগে এই গাছগুলো লাগানো হয়। কলের গহবরে তিনটি ফুলগাছ
হারিয়ে গেছে, বাকী চারটি গাছ এখনো এখনো জীবিত রয়েছে।
এই দিঘির
প্রধান অকার্ষণ হলো পানির মধ্যে জীবিত থাকা এই ফুল গাছগুলো বছরের ৬ মাস মরা থাকে আবার
৬ মাস পরে জীবিত হয়ে নতুন পাতা ছেড়ে ফুল ফোঁটে। অতি সুন্দর ও সৌরবময় এমন ফুল এদেশের
আর কোথাও দেখা যায় না। এই ফুল গাছ কেই তুলে বাড়িতে লাগায় না, তার কারণ আন্য কোথাও লাগালে
তা মারা যায়।
কিভাবে যাওয়া
যায়:
সড়ক পথে-
ঢাকা থেকে ঢাকা-খুলনা জাতীয় মহাসড়কে যশোর অতিক্রম করে রাজার হাট নামক স্থান হতে সাতক্ষীরা
রোডে প্রায় ০৭ কিঃমিঃ মণিরামপুর এর দিকে সড়ক সংলগ্র ভোজগাতী ইউপির অধীন।