গিনি ঘাস চাষ

গিনি ঘাস চাষ



কৃষি প্রধান দেশ হিসাবে বাংলাদেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ কম-বেশি কৃষির উপর নির্ভরশীল যদিও বর্তমানে হাল চাষের কাজ কলের লাঙ্গল দিয়ে করা হয় তবুও গ্রাম-বাংলার জনপদে কৃষির বেশির ভাগ কাজেই গবাদি পশু ব্যবহৃত হতে দেখা যায় গ্রাম এলাকায় কৃষকেরা বিভিন্ন প্রয়োজনে গরু পালন করে থাকে হয় হাল চাষের কাজে না হয় তো দুধের গরু হিসাবে এদের পালন করে থাকে তবে দেশে গবাদিপশু পালন ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করেছে আর গরুর সংখ্যা কমার প্রধান কারণ হলো গো-খাদ্যের অভাব গো-খাদ্যের মধ্যে কাঁচা ঘাসের অভাব খুবই প্রকট এই কাঁচা ঘাসের সরবরাহ ত্বরান্বিত করতে না পারলে আগামীতে গবাদি পশু পালন হুমকির সম্মুখীন হবে বলে মনে করা হয়
এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষ মাথাপিছু দৈনিক ৩২. মিলি দুধ খায় (উৎসঃ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০০৬) অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার হিসাব অনুযায়ী একজন মানুষের দৈনিক ২০০ মিলি দুধ খাওয়া প্রয়োজন এই বিশ্লেষণ থেকে একথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, বাংলাদেশের মানুষ দৈনিক মাথাপিছু গড়ে অতি নগন্য পরিমাণে দুধ পান করে থাকে দেশে গুঁড়া দুধ দুগ্ধজাত পণ্য আমদানিতে বছরে প্রায় ৪০০-৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় বাংলাদেশের শিশুরা যে গুঁড়া দুধ খায় তা যে আসলে কি নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে বিতর্ক রয়েছে মায়ের দুধ মাস বয়স থেকে শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত হয় না তাই পুষ্টিবিদরা মাস বয়সের পর থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুদেরকে গরুর তরল বিশুদ্ধ দুধ খাওয়াতে বলে থাকেন কিন্তু গরুর তরল দুধের অপ্রতুলতায় শিশুরা তা পায় না বললেই চলে ফলে শিশুরা গুঁড়া দুধ বা অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য খেতে বাধ্য হচ্ছে এই গুঁড়া দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্য খেয়ে আমাদের শিশুদের শারীরিক-মানসিক বিকাশ দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে আগামী প্রজন্ম পুষ্টিহীন দূর্বল হয়ে বেড়ে উঠছে
 
পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদেরকে দুধ উৎপাদন বাড়াতে হবে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গবাদি পশুর জাত উন্নয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ জাতের উন্নয়নের পাশাপাশি খাদ্য চাহিদাপূরণ দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে খাদ্যের মধ্যে কাঁচা ঘাসের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি দেশে কাঁচা ঘাসের সরবরাহ খুবই কম তাই যে কোনো মূল্যে কাঁচা ঘাস উৎপাদন বাড়াতে আমাদেরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে

বাংলাদেশ খুবই ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ এদেশে যে জমি আছে তা দিয়ে মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় অর্থাৎ প্রায় সমস্ত জমিই মনুষ্য খাদ্য-শস্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে গো-খাদ্য উৎপাদনে আর কোনো জায়গা থাকছে না পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যবহৃত কৃষি ফলের বাগান বা উচুঁ পরিত্যক্ত বা পতিত জমিতে ঘাস চাষ বিষয়ে কৃষক ভাইদেরকে সচেতন করে তুলতে হবে এর ফলে ঘাস উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে যা দিয়ে কৃষক ভাইয়েরা গবাদির খাদ্য চাহিদা মিটাতে সক্ষম হবেন বলে আশা করা যায় এতে করে আমাদের কাঙ্খিত দুধ মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে প্রতিহত হবে দুধ আমদানি সাশ্রয় হবে দেশের অর্থ সুস্থ্য-সবল হয়ে বেড়ে উঠবে আমাদের আগামী প্রজন্ম

আজ আমরা এমন একটি ঘাস নিয়ে আলোচনা করবো যার উৎপাদন বেশি দেশের সকল এলাকায় জন্মে এমন কি আম, কাঁঠাল, নারিকেল, সুপারী অন্যান্য বাগানে এই ঘাস চাষ করা যায় কৃষক ভাইয়েরা যদি আধুনিক কলা-কৌশল ব্যবহারে সচেতন হন তাহলে কাঙ্খিত ঘাস উৎপাদন সম্ভব ঘাসটির নাম গিনি
গিনি গ্রীষ্মমন্ডলীয় স্থায়ী ঘাস আফ্রিকা-এর আদি বাসস্থান ঘাসটি ১৭৯৩ সালে আফ্রিকা হতে ভারতে পরিচিতি লাভ করে গিনি দেখতে অনেকটা ধান গাছের মত এতে নেপিয়ার পারা ঘাসের তুলনায় জলীয় ভাগ কম এবং পুষ্টিমান বেশি কান্ড চ্যাপ্টা পাতা অমসৃন কান্ড পাতায় কোনো সুঙ (Cilia) নেই

জমি নির্বাচন
গিনি ঘাস উঁচু ঢালু জমিতে ভাল হয় ছায়াযুক্ত জমিতেও ঘাস জন্মে কাজেই আম, কাঁঠাল, নারিকেল, সুপারী অন্যান্য বাগানে ঘাস লাগানো যায় স্যাঁতস্যাঁতে জলাবদ্ধ নিচু জমিতে ঘাস ভাল হয় না

বংশ বিস্তার
ঘাস বীজ উৎপাদনে সক্ষম বীজ মোথা দুই পদ্ধতিতেই গিনি ঘাসের চাষ করা যায়

চাষের সময়
গিনি ঘাস বৈশাখ হতে জ্যৈষ্ঠ মাস অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমের প্রথম বৃষ্টির পরেই রোপন করতে হয় বেশি বৃষ্টি বা জলাবদ্ধ অবস্থায় চারার গোড়া পচে যেতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে তবে মাটিতে প্রচুর রস থাকলে অথবা পানি সেচের সুবিধা থাকলে এবং গ্রীষ্মের শুরুতে রোপণ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়

জমি চাষ রোপণ পদ্ধতি
জমি /৩টি চাষ মই দিয়ে তৈরি করতে হবে এর পর বড় মোথা হতে /৫টি ছোট চারা তৈরি করতে হবে চারাগুলি / ইঞ্চি লম্বা হতে হবে এক সারি হতে অন্য সারির দূরত্ব / ফুট, এক গাছ হতে অন্য গাছের দূরত্ব ফুট এবং / ইঞ্চি মাটির গভীরে লাগাতে হবে চারার গোড়া ভালোভাবে মাটি দিয়ে টিপে দিতে হবে

চারা বীজের পরিমাণ
সারি থেকে সারি ফুট এবং গাছ থেকে গাছ -. ফুট দূরত্বে লাগালে একরে প্রায় ১২,০০০ চারার দরকার হয় বীজের ক্ষেত্রে প্রতি একরে বীজের পরিমাণ - কেজি

সার সেচ প্রয়োগ
জমির উর্বরা শক্তির উপর নির্ভর করে ঘাসের উৎপাদন জমি তৈরির সময় প্রতি একরে কমপক্ষে টন গোবর বা টন মুরগির বিষ্ঠা এবং ৪৫ কেজি টিএসপি সার দিতে হবে চারা রোপনের পরে চারা মাটিতে ধরে গেলে একর প্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে তাছাড়া প্রতিবার ঘাস কাটার পর একর প্রতি ৪০ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে ইউরিয়া প্রয়োগের সময় জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে সার প্রয়োগ করে সেচ দিতে হবে

সাথী ঘাস
গিনি ঘাসের সাথে শুটি যেমন সেন্ট্রোসীমা, সিরাট্রো, গ্লাইসিন ইত্যাদি সাথী ঘাস হিসাবে চাষ করা যেতে পারে সমস্ত শুটি গিনি ঘাস লাগানোর সময় দুই চারার মধ্যবর্তী স্থানে অথবা ছিটিয়ে বপন করা যায়

ঘাসের পরিচর্যা
সারির মাঝের ফাঁকা জায়গা ঘাস কাটার পর পরই আলগা করে দিতে পারলে ভাল ফলন পাওয়া যায় যদি প্রত্যেকবার ঘাস কাটার পর সম্ভব নাও হয়, তবে অন্তত বছরে এক বা দুই বার মাটি আলগা করে দিতে হয় মাটি আলগা করে সার পানি দিতে পারলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়

ঘাস কাটার নিয়ম ফলন
গিনি ঘাস লাগানোর ৬০-৭০ দিন পরই প্রথম বার ঘাস কাটা যায় পরবর্তী ৪০-৪৫ দিন পরপর কাটা যায় ঘাসের খাদ্যমান বেশি পেতে হলে কচি অবস্থায় কেটে গবাদিপশুকে খাওয়াতে হবে ঘাস মাটি হতে / ইঞ্চি রেখে কাটতে হবে ভাল যত্ন বা পরিচর্যা করলে এই ঘাস বছরে / বার কাটা যেতে পারে ভাল ব্যবস্থাপনায় একর প্রতি প্রায় ২০-৩০ টন কাঁচা ঘাস উৎপন্ন হয়

গিনি ঘাসের খাদ্য মান

ঘাস খাওয়ানোর নিয়ম
গরু মাঠে চরিয়ে কাঁচা ঘাস হিসাবে গিনি ঘাস খাওয়ানো যেতে পারে তবে মাঠ থেকে কেটে এনে খাওয়ানোই উত্তম এক্ষেত্রে / ইঞ্চি টুকরা করে শুকনা খড়ের সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো ভাল যদি একটি গাভীর দৈহিক ওজন ১০০ কেজি হয়, তা
হলে-এর দৈনিক খাদ্য তালিকায় . কেজি দানাদার খাদ্য, .৪০ কেজি শুকনা খড় এবং প্রায় . কেজি গিনি ঘাস সরবরাহ করা যেতে পারে তবে যদি এই গাভীকে (১০০ কেজি ওজনের) ইউরিয়া মোলাসেস মিশ্রিত খড় খাওয়ানো হয় সেক্ষেত্রে . কেজি দানাদার খাদ্য . কেজি শুকনা খড়, .-. কেজি সবুজ গিনি ঘাস এবং -. কেজি ইউরিয়া মোলাসেস মিশ্রিত খড় প্রতিদিন সরবরাহ করা যেতে পারে
এই হিসাব অনুযায়ী গাভীর শারীরিক ওজন অনুপাতে প্রয়োজনীয় খাদ্যের মোট পরিমাণ নির্ধারণ করে-এর অর্ধেক সকালে এবং বাকী অর্ধেক বিকালে খাওয়াতে হবে এর সাথে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

সংরক্ষণ
গিনি ঘাস কচি অবস্থায় কেটে রৌদ্রে শুকিয়েহেকরে রাখা ভাল তবে এই ঘাস সাইলেজ করেও রাখা যায়
গাভীর দুধ উৎপাদন সু-স্বাস্থ্যের জন্য কাঁচা ঘাসের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য কাঁচা ঘাসের সরবরাহ বাড়ানো ছাড়া মাংস দুধ উৎপাদন বাড়ানো অসম্ভব প্রায় সেক্ষেত্রে উচ্চ ফলনশীল ঘাস হিসাবে গিনি বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে চাষ হতে পারে আমাদের জমির স্বল্পতা আছে সত্য, তবে পরিত্যাক্ত উঁচু জমি, বিভিন্ন ফলের বাগানে ঘাস চাষ করে ঘাস উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে জাতীয় ঘাস সঠিক নিয়মে গবাদিপশুকে খাওয়ানো হলে দুধ মাংসের উৎপাদন বাড়বে বলে আশা করা যায় এতে করে মানুষের পুষ্টি চাহিদা যেমন পূরণ হবে তেমনি গুঁড়া দুধ দুগ্ধ পণ্য আমদানি কমবে পলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাববান হবে

Post a Comment

Previous Post Next Post