তেঁতুলের উপকারিতা ভেষজগুণ ও পুষ্টিমান
তেঁতুল (Tamarindus indica) ফলটি ঋধনধপবধব পরিবারের অর্ন্তভুক্ত তেঁতুলের নাম শুনতেই জিভে পানি এসে যায়। তেঁতুল
পছন্দ করে না এমন নারী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাহলে
কী
ছেলেরা এ তালিকায় নেই? তাও কী করে বলি! খেতে বসলে দেখা যায়, কোনো কোনো পুরুষ মেয়েদেরও হার মানায়। আসলে
এ
ফলটি
সবার
কাছে
অন্য
এক
আকর্ষণ। দক্ষিণ
আফ্রিকায় মূল্যবান খাবারের মধ্যে তেঁতুলের স্থান অন্যতম। অথচ গ্রামাঞ্চলের
কেউ
কেউ
মনে
করেন,
তেঁতুল খেলে রক্ত পানি হয়ে যায়; সে সাথে বুদ্ধিও কমে। এজন্য
বাচ্চাদের তেঁতুল খেতে বারণ করা হয়। এগুলো
নিছক
কুসংস্কার। বাস্তবে
ঠিক
উল্টো। তেঁতুল
রক্ত
পরিষ্কার করে। মস্তিষ্কে
চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। কাঁচা
তেঁতুল খেতে টক, পাকা ফল টক-মিষ্টির এক ভিন্ন স্বাদ। তেঁতুল
খাবারে স্বাদ বাড়ায়। এজন্য
মাংসের রোস্ট, পোলাও, খিচুড়িতে ব্যবহার হয়। তেঁতুলের
টক,
ভর্তা, ডাল অনেকের প্রিয়। এছাড়া
তৈরি
করা
যায়
আচার,
সস,
জ্যাম, চাটনিসহ আরো খাবার। আছে অনেক
পুষ্টি। ভেষজগুণেও
টইটম্বুর। এর বীজ নকশি
শিল্পে ব্যবহার হয়। এসব কারণে
তেঁতুলকে বলা হয় বিস্ময়কর ফল। তাই এর পরিচিতি,
গুণাগুণ এবং চাষাবাদ সম্পর্কে জেনে নেয়া দরকার।
তেঁতুল লেবুজাতীয় ফল। বরিশালের
আঞ্চলিক ভাষায় তেতৈ আর নোয়াখালীতে বলে তেতি। আদিবাসীরাও
বিভিন্ন নামে ডাকে। মারমাদের
ভাষায় হাও মং এবং রাখাইনরা
বলে
তাতু। ইংরেজিতে ট্যামারিন্ড, বৈজ্ঞানিক নাম ট্যামারিন্ডুস ইন্ডিকা। হিন্দিতে
ইমলি
এবং
শ্রীলঙ্কায় ইয়াম্বালা বলা হয়। এর আয়ুর্বেদিক
নাম
যমদূতিকা। তেঁতুল
দীর্ঘজীবী বৃক্ষ। কয়েকশত
বছর
ধরে
বেঁচে থাকে। আকারেও বেশ বড় হয়। দেখতে
খুবই
সুন্দর। অধিক
শাখা-প্রশাখা
থাকায় প্রতিকূলতার সহ্য ক্ষমতা রয়েছে যথেষ্ঠ। গাছের
উচ্চতা সাধারণত ৭০ থেকে ৮০ ফুট হয়ে থাকে। এর আদি নিবাস
আফ্রিকার সাভানা অঞ্চল। তবে সুদান
থেকে
বীজের মাধ্যমে বাংলাদেশে বংশবিস্তার হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এ দেশের
সব
জেলাতে তেঁতুল গাছ থাকলেও রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, বগুড়া এবং গাজীপুরে বেশি দেখা যায়। আমাদের
দেশে
এমনিতেই জন্মে থাকা এবং অনাদরে বেড়ে ওঠা এ বৃক্ষটির অনুমোদিত জাত নেই। তবে বাংলাদেশ
কৃষি
গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০০৯ সালে পাহাড়ি এলাকায় চাষ উপযোগী বারি তেঁতুল-১ নামে একটি মিষ্টি তেঁতুলের জাত উদ্ভাবন করেছে। তেঁতুলগাছে
মার্চ মাসে ফুল আসে। এর রঙ হালকা
বাদামি। ফল পাকে
পরের
বছর
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে। ফুল থেকে
ফল
পরিপক্ব হতে প্রায় ১০ মাস সময় লাগে। ফল কাঁচা
অবস্থায় সবুজ এবং পাকলে হয় গাঢ় বাদামি। এর আকার
৬x৮ ইঞ্চি
লম্বা। প্রতিফলে
৫x১২টি
বিচি
থাকে। বীজ দেখতে খয়েরি। কেউ কেউ এখনো
বিশ^াস করেন,
তেঁতুল গাছে ভূতের আড্ডাখানা। আর সে কারণে
ঘরের
পাশে
এ
গাছ
রাখতে মানা। এগুলো
অহেতুক ভয়। আসলে
তেঁতুলগাছ বহু পাতাবিশিষ্ট বৃক্ষ হওয়াতে স্বাভাবিকভাবে রাতের বেলা অধিক পরিমাণে অক্সিজেন গ্রহণ করে, একই সাথে কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে। এ সময় গাছের
নিচের চারপাশে অক্সিজেনের শূন্যতা দেখা দেয়। আর সে মুহূর্তে
কোনো
লোক
যদি
গাছের নিচে অবস্থান করে অথবা ঘুমিয়ে থাকে তাহলে অক্সিজেনের অভাবে অজ্ঞান কিংবা ঘাড় বাঁকা হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে।
পুষ্টিগুণ :
তেঁতুলে আছে চোখ ধাঁধানো পুষ্টি। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের
মতে,
এর
প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচাফলে (আহারোপযোগী) ক্যালসিয়াম আছে ২৪ মিলিগ্রাম এবং পাকাফলে রয়েছে ১৭০ মিলিগ্রাম। আয়রনের
পরিমাণ কাঁচাফলে ১ মিলিগ্রাম
এবং
পাকাফলে আছে ১০.৯ মিলিগ্রাম
করে। কাঁচাফলে অন্য পুষ্টি উপাদানগুলো হলো- ১.১ গ্রাম আমিষ, ১৩.৯ গ্রাম শর্করা, ০.২ গ্রাম চর্বি, ০.০১ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি১, ০.০২ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি২, ৬ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ১.২ গ্রাম খনিজ লবণ এবং খাদ্যশক্তি আছে ৬২ কিলোক্যালরি। পাকা
তেঁতুলে পুষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি। এর প্রতি
ফলে
৩.১ গ্রাম
আমিষ,
৬৪.৪ গ্রাম
শর্করা, ০.১ গ্রাম চর্বি, ০.০৭ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি২, ৩ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ০.১ মিলিগ্রাম ভিটামিন ই, ১১৩ মিলিগ্রাম ফসফরাস, ২৮ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৬২৮ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম, ৯২ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম, ১.৩ মিলিগ্রাম
সিলিনিয়াম, ০.১২ মিলিগ্রাম দস্তা, ০.৮৬ মিলিগ্রাম তামা এবং খাদ্যশক্তি আছে ২৮৩ কিলোক্যালরি।
ভেষজগুণ :
ইউনানি, আয়ুর্বেদি, হোমিও এবং অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের কাঁচামাল হিসেবে তেঁতুল সমাদৃত। এর পাকা
ফল
হৃদরোগের জন্য উপকারী। উচ্চ
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। তেঁতুলের
সাথে
রসুন
মিশিয়ে খেলে রক্তের কোলস্টেরল কমে। নিয়মিত
তেঁতুল খেলে প্যারালাইসিস রোগীর অনুভূতি ফিরে আসে। টারটারিক
অ্যাসিড থাকায় হজমশক্তি বাড়ায়। তাই পেটফাঁপা
ও
কাশি
দূর
করতে
পুরোনো তেঁতুল গুলে; সে সাথে পরিমাণমতো পানি,
লবণ,
গুড়
অথবা
চিনি
মিশিয়ে খেতে হবে। বুক ধড়ফড়,
মাথা
ঘুরানো, হাত-পা জ¦ালা, কোষ্ঠকাঠিন্য, আমাশয় ও ক্ষুধামন্দা
নিরাময়ে বেশ কাজ করে। তেঁতুল
অতিরিক্ত ফ্যাট বের করে প্রজননতন্ত্রের কাজ শক্তিশালী
করে। ধুতরা, কচু এবং অ্যালকোহলের বিষাক্ততা নিরাময়ে তেঁতুলের শরবত বেশ কার্যকরী। গাছের
পাতা
ও
ছাল
অ্যান্টিসেপটিক এবং অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল। তাই শরীরের
ক্ষত
সারাতে সাহায্য করে। পাশাপাশি
হাঁপানি, চোখ জ্বালাপোড়া এবং দাঁতব্যথা সারিয়ে তুলে। নিয়মিত
ঘণ্টাখানিক হেঁটে ২৫-৩০ গ্রাম তেঁতুল খেলে হৃদপি-ে ব্লক হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। গর্ভাবস্থায়
মায়েদের বমিবমিভাব দূর করে। কাঁচা
তেঁতুল গরম করে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে প্রলেপ দিলে ব্যথা সেরে যায়। মুখে
ঘা
হলে
পানির সাথে তেঁতুল মিশিয়ে কুলকুচা করলে আরাম পাওয়া যায়। নিরাময়েও
কাজ
হয়। কোনো কোনো এলাকার মানুষ তেঁতুলপাতা বেঁটে, মরিচ ও লবণ মিশিয়ে বড়া বানিয়ে পান্তাভাতের সাথে খান। এতে শরীরে
অনেক
উপকারে আসে। কচি পাতায়
প্রচুর পরিমাণে অ্যামাইনো অ্যাসিড রয়েছে। পাতার
রস
সর্দি, কাশি, প্রস্রাবের যন্ত্রণা, পাইলস, কৃমি ও চোখওঠা সারাতে সহায়তা করে। তেঁতুলের
বিচিতে এক ধরনের অ্যানজাইম আছে, যা রক্তের চিনির মাত্রা কমায়। এতে ডায়াবেটিস
নিয়ন্ত্রণে থাকে। এছাড়া
এর
গুঁড়া নিয়মিত খেলে পেটের আলসার ভালো হয়। তেঁতুলের
তৈরি
শরবত
খেতে
অন্যরকম স্বাদ। অনেক
রোগের মহৌষধ। শরবত
বানানোর জন্য আধাকাপ পরিমাণ পানিতে কয়েক ঘণ্টা ভিজিয়ে গুলিয়ে নিতে হয়। এরপর
ছাকুনি দিয়ে ছেঁকে, অন্য পাত্রে দেড় কাপ পানিতে পরিমাণমতো গুড় গুলিয়ে, সে মিশ্রণ মেশাতে হবে। সাথে
থাকবে আয়োডিনযুক্ত লবণ। পরে আরো এক কাপ স্বাভাবিক
কিংবা ঠাণ্ডা পানি। এভাবেই
হয়ে
যাবে
ভেষজ
শরবত। এরপর গ্লাসে ঢেলে রুচিমতো লেবুর রস দিয়ে নিজে খাওয়া এবং অন্যদের পরিবেশন। তেঁতুলের
পাতা
দিয়ে
ভেষজ
কীটনাশক তৈরি করা যায়। এজন্য
একটি
পাত্রে এক লিটার
পানির সাথে ১০x১২ গ্রাম শুকনো পাতা এক সপ্তাহ ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর
পাত্রটি ঢাকনা দিয়ে ১ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। এবার
ঢাকনা সরিয়ে ২/৩ টুকরা রঙিন পলিথিন দিয়ে এমনভাবে মুখ বন্ধ
করতে
হবে
যেন
ভেতরে বাতাস ঢুকতে না পারে। এভাবে
এক
সপ্তাহ রেখে দিতে হয়। এবার
ছাকুনির সাহায্যে ছেঁকে নিলেই হয়ে যাবে ফসলের ক্ষতিকর পোকা মারার কীটনাশক। ব্যবহারের
ক্ষেত্রে প্রতি লিটার পানিতে ৫ মিলিলিটার ভেষজ কীটনাশক মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে।
Tags:
Beauty & Fitness