রোগ নিরাময়ে পুদিনার প্রয়োগ ও ব্যবহার
বোটানিক্যাল নাম : Menth spicata; পরিবার : Labitae; ইংরেজি নাম : Mint পুদিনার সুগন্ধির কারণে বিভিন্ন মুখরোচক কাবাব, সলাদ, বোরহানি ও চাটনি তৈরিতে ব্যবহার হয়। কাঁচা
পুদিনা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় চাটনি ও সালাদে। ইদানিং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে টক দই এবং বোরহানি তৈরির জন্য পুদিনার ব্যবহার বাড়ছে। এছাড়া
মাছ,
মাংস,
সস,
স্যুপ, স্টু, চা, তামাক, শরবত তৈরিতে পুদিনা পাতা ব্যবহার হয়। ইউরোপের
দেশগুলোতে ভেড়ার মাংসের রোস্ট ও মিন্ট জেলি তৈরিতে পুদিনা পাতা ব্যবহার হয়। বিভিন্ন
দেশে
পুদিনার বেশি ব্যবহার হচ্ছে তেল তৈরিতে। পুদিনার
গাছ
থেকে
পাওয়া এ তেলের নাম পিপারমেন্ট অয়েল। এ তেল বেশ মূল্যবান। বিভিন্ন শিল্প বিশেষ করে ওষুধ, টুথপেস্ট, মিন্ট চকোলেট, ক্যান্ডি, চুইয়িংগাম ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এসবে এটি ব্যবহার হয়। কোনো
কোনো
ব্র্যান্ডের সিগারেটেও মেন্থল
ব্যবহার হয়। তাই পুদিনা
গাছের শিল্প মূল্য অনেক বেশি। পুদিনা
পাতার তীব্র ঘ্রানের জন্য দায়ী উপাদান মেন্থল
ও
মেন্থোন। প্রতি
বছর
আমাদের বাংলাদেশে ১৮ টন কাঁচা পুদিনা পাতার চাহিদা রয়েছে। পুদিনা
পাতার ওপর ভিত্তি করে পিপারমেন্ট অয়েল শিল্প স্থাপন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সাথে সাথে প্রচুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে। প্রতিবেশী
দেশ
ভারতে প্রতি বছর ১০ টনের ও অধিক পিপারমেন্ট তেলের চাহিদা রয়েছে। হিসাব
করে
দেখা
গেছে,
এ
পরিমাণ তেল উৎপাদনের জন্য ১০ হাজার একর জমি প্রয়োজন। কিন্তু
উৎপাদন অনেক কম হওয়ায় ভারতে প্রতি বছর কোটি টাকার পিপারমেন্ট তেল আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশের
বাজারে মূলত কাঁচা পুদিনার চাহিদাই বেশি। বিরুৎ
অর্থাৎ খুবই ছোট আকারের প্রকৃতির গাছ পুদিনা। কা- ও পাতা
নরম। পাতা ডিম্বাকার, কিনারা খাঁজকাটা। পাতা
লোমশ,
তীব্র মিষ্ট গন্ধযুক্ত। গাছের
উচ্চতা ৫০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার। গাছের
গোড়া
থেকে
ধাবক
বা
রানার বের হয়। গাছ দ্রুত
বাড়ে
ও
ঝোপ তৈরি করে। এর জাপানি
জাতটি চাষের জন্য ভালো। আমাদের
দেশে
যে
পুদিনা চাষ হয় তার কোনো ফল হয় না। অতীত
থেকে
এ
দেশে
পুদিনা পাতা ব্যবহার হয়ে আসছে। এক সময় ছিল যখন বাড়ির
আঙিনায় ২ থেকে ৪টি পুদিনা গাছ লাগিয়ে পরিবারের চাহিদা মিটানো হতো। কিন্তু
এখন
অবস্থা বদলে গেছে। শহরাঞ্চলে
পুদিনার চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। পুদিনার
চাষ
এখন
অন্যান্য ফসলের মতো বাণিজ্যিকভাবে করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
রোগ নিরাময়ে পুদিনা
অরুচিতে
: সাধারণত কিছুদিন রোগে ভোগার এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে
পুদিনার শরবত (পুদিনার রস) ২ চা-চামচ, সামান্য লবণ মরিচ চূর্ণ এক টিপ, কাগজিলেবুর রস ৮ থেকে ১০ ফোটা ও হালকা গরম পানি ২৫০ গ্রাম একত্রে মিশিয়ে সকালে একবার ও বিকালে একবার; এভাবে ৫ থেকে ৭ দিন খেলে অরুচি চলে যাবে। এছাড়া
পুদিনা পাতা বেটে পানিতে গুলেও শরবত করা যায়। সে ক্ষেত্রে
কাঁচা পাতা ৮ থেকে ১০ গ্রাম নিতে হবে। পুদিনা
পাতার চাটনি একাধারে ৮ থেকে ১০ দিন খেলেও অরুচি কমে যাবে।
পেট ফাঁপায়
: এক্ষেত্রে পুদিনার শরবত সারা
দিনে
২-৩ বার করে কয়েক
দিন
খেলে
পেটে
বায়ু
জমা
বন্ধ
হবে
এবং
খাদ্য রুচিও ফিরে আসবে এবং হজম শক্তিও বাড়বে।
বমিতে
: পিত্ত, শ্লেষ্মাজ্বর, অম্লপিত্ত, আমাশয়, অজীর্ণ, উদরশূল প্রভৃতিতে বমি হতে পরে, আবার রোদে ঘোরাফেরা করে ঠা-া পানি খেলে এবং খালি পেটে থেকে পরিশ্রম করলে বমি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এসব ক্ষেত্রে
পুদিনার শরবত (পুদিনার পাতা ৮ থেকে ১০ গ্রাম বেটে তাতে পুরনো তেঁতুল ১ চা চামচ, সামান্য একটু চিনি ও লবণ এবং পানি ২৫০ গ্রাম একত্রে মিশিয়ে) দিনে ২ থেকে ৩ বার করে কয়েক দিন খেলে বমি সেরে যাবে।
মূত্রাল্পতায়
: যে
ক্ষেত্রে গরমের ফলে অল্প অল্প করে প্রস্রাব হতে থাকে, কোনো কোনো সময় সে সাথে জ্বালাও থাকে, সেক্ষেত্রে পুদিনার পাতা ৮ থেকে ১০ গ্রাম ভালোভাবে বেটে তাতে সামান্য লবণ ও কাগজিলেবুর রস এবং পোয়াখানিক ঠা-া পানি মিশিয়ে শরবতের মতো করে দিনে ২ থেকে ৩ বার খেতে হবে। এর ফলে প্রস্রাব
সরল
হবে। তারপর এ সমস্যার জন্য মাঝে মাঝে খেলেও প্রস্রাব স্বাভাবিক থাকবে।
মুখের বিস্বাদে : টাটকা পুদিনা পাতা, শুকনো খেজুর, গোলমরিচ, লবণ, জিরা ও কালো আঙুর পরিমাণ মতো মিশিয়ে একসাথে পিষে চাটনি তৈরি করুন। এতে লেবুর
টাটকা রস মিশান। এ চাটনি
খেলে
মুখে
রুচি
আসবে,
মুখের বিস্বাদ দূর হয়ে খাওয়ার ইচ্ছা হবে, বায়ুজনিত অস্বস্তি দূর হবে, হজম শক্তি বাড়বে, শরীরের নিস্তেজ ভাব দূর হবে।
পেটের বায়ু দূর করতে : পুদিনাপাতা, তুলসীপাতা, গোলমরিচ ও আদা পরিমাণ মতো একসাথে মিশিয়ে পিষে নিয়ে পানিতে জল সেদ্ধ করে, একটা ঘন ক্বাথ তৈরি করুন। এ ক্বাথ
চামচে নিয়ে অল্প একটু জিহ্বা দিয়ে চেটে অন্তত ৪ বার করে ৩ দিন খেলে পেটের বায়ু দূর হবে ও খুব ক্ষিদে পাবে।
সাইনাসে
: টাটকা পুদিনা পাতা পিষে বা থেঁতো করে রস বের করে নিন। এ রস কফ, সর্দি, কপালে সাইনাসের কারণে জমে যাওয়া ঘন সর্দিও বের করে আনবে। প্রতিদিন
১
চামচ
করে
২
বার
এবং
১৫
থেকে
২০
দিন
খাবেন।
পুরনো সবিরাম জ্বরে : টাটকা
পুদিনাপাতা ও তুলসীপাতা একসঙ্গে পিষে পানিতে জল মিশিয়ে পাত্র ঢাকা দিয়ে, ঘন ঝোল বা ক্বাথ তৈরি
করুন। প্রতিদিন যে জ্বর কোনো একটা বিশেষ সময়ে একটানা বহু দিন ধরে আসে এ ক্বাথ প্রতিদিন ২ থেকে ৩ বার করে অন্তত সপ্তাহখানেক খেলে জ্বর সারবে।
টাইফয়েডে
: পুদিনাপাতা, সবুজ তুলসী ও তুলসীর রস এক সাথে মিশিয়ে থেঁতো করে নিন। এতে স্বল্প
চিনি
মিশিয়ে অল্প করে দিনে ৪ বার খাবেন। কিছুদিন
খেলেই জ্বর চলে যাবে।
নিউমোনিয়াতে
: পুদিনাপাতা, টাটকা রস অল্প মধুর সাথে মিশিয়ে, প্রতি ২ ঘণ্টা পরপর ১ চা চামচ করে খাওয়ালে ত্রিদোষ জ্বর অর্থাৎ নিউমোনিয়া রোগীর অনেক বিকার দূর হবে এবং জ্বরও তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।
অন্ত্রের দুবর্লতায় : পুদিনা পাতায় টাটকা রস মধু মিশিয়ে খাওয়ালে অন্ত্রের দুবর্লতা ও পেটের অসুখ সারে। যারা
বহু
দিন
ধরে
আন্ত্রিক গোলযোগে ভুগছেন তাদের পক্ষে টাটকা পুদিনা পাতার রস খাওয়া অমৃতের মতো উপকারী।
সংক্রমণ প্রতিরোধে : যখন কলেরা ও আন্ত্রিক রোগ প্রবলভাবে ছড়িয়ে মহামারীর রূপ নেয়, তখন টাটকা পুদিনা পাতার রসে মধু ও লেবুর রস মিশিয়ে শরবত তৈরি করে খেলে সংক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
তীব্র পেটের ব্যথায় : পুদিনা পাতার রস ১ চা চামচ ও আদার রস ১ চা চামচ একসাথে মিশিয়ে তাতে অল্প লবণ দিয়ে এ রস দিনে ২-৩ বার খেলে তীব্র পেটের ব্যথা (উদরশূল) সেরে যাবে।
পুদিনা পাতার আরও ব্যবহার
ক. দাদের ওপর বার বার পুদিনা পাতার রস লাগালে উপকার পাওয়া যাবে;
খ. নাকের ভেতর পুদিনা পাতার রসের ১-২টি ফোটা ফেললে সর্দি সারে;
গ. পুদিনা পাতা চিবিয়ে বিছার কামড়ের জায়গায় লাগালে কামড়ের কষ্ট বা ব্যথা দূর হবে;
ঘ. পুদিনা পাতা পুড়িয়ে ছাই দিয়ে দাঁত মাজলে দাঁতের মাড়ি শক্ত হয়;
ঙ. মধুর সাথে পুদিনা পাতার রস মিশিয়ে খেলে শরীরের জমে থাকা ক্লেদ ঘা হয়ে বেরিয়ে যায়;
চ. খালি পেটে মধ ুও লবণ মিশিয়ে পুদিনা বাটা খেলে কৃমি সারে;
ছ. কফ সর্দিজ্বর ও কুষ্ঠ রোগের জন্য পুদিনা পাতা উপকারী;
জ. পুদিনা পাতা কচলে নিয়ে শুকিয়ে দিলে মুর্চ্ছা রোগে উপকার হয়;
ঝ. পুদিনা পাতা সেদ্ধ করে বেটে মধুর সাথে মিশিয়ে খেলে পায়ের গোদের উপকার হয়;
ঞ. বৈজ্ঞানিক গবেষণা মতে পুদিনা পাতায় ভিটামিন-এ বেশি পরিমাণে আছে। ভিটামিনের
গুণের দিক থেকে দেখলে পুদিনাকে পৃধিবীর সব রোগ থেকে রক্ষাকারী একটি ঔষধি বা উপকারী উদ্ভিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। পুদিনাতে
খিদে
বাড়ানোর শক্তি আছে খুব বেশি পরিমাণে। রুচি
বাড়াতে এর তুলনা বিরল। হাকিমি
বা
ইউনানি মতে পুদিনা বমি ও হেঁচকি ওঠা বন্ধ করে। পাকস্থলী,
বুকে
ও
কিডনির যাবতীয় গ্লানি ও ক্লেদ দূর করে। আয়ুর্বেদ
মতে,
পুদিনা স্বাদ ও খাওয়ার রুচি বাড়ায়, খিদে বাড়ায়, বল বৃদ্ধি করে, মনে ও শরীরে সুখের আমেজ আনে, অত্যধিক মলত্যাগ ও মূত্রাবেগ থামায়, কফ ও বাত কমায়। কাশি,
উম্মত্ততা, অজীর্ণ বা বদহজম, পেটের অসুখ, একটানা পুরানো পেটের অসুখ, পুরনো জ্বর ও আন্ত্রিক রোগ সারায়। কৃমিও
অরুচিনাশ করে, বমি থামিয়ে দেয়। পুদিনার
চাটনি যেমন খেতে মুখরোচক তেমনি হজমেও সাহায্য করে। পুদিনা
চা
পুদিনার পাতা, দুধ,চিনি, গোলমরিচ ও মৌরি গরম পানিতে দিয়ে এ চা তৈরি করতে হবে। চা খেতে
সুস্বাদু এবং খেলে তৃপ্তি হয়। শরীরের
পক্ষে পুষ্টিকর ও হিতকর পানীয়। স্বাস্থের
পক্ষে ভালো এবং সব দিক থেকে উপকারী। পুদিনা পাতার বহুবিদ গুণের কারণে একে অজীর্ণহর, শোক শোভন, সুগন্ধিপত্র এসব নামে ডাকা হয়।
Tags:
Beauty & Fitness