Lalbagh Kella (Historic Site) লালবাগ কেল্লা (ঐতিহাসিক স্থান)
লালবাগ
কেল্লা, মোঘল আমলের বাংলাদেশের একমাত্র ঐতিহাসিক নিদর্শন যাতে একই সাথে ব্যবহার করা হয়েছে কষ্টি পাথর, মার্বেল পাথর আর রঙ-বেরঙের টালি। লালবাগ কেল্লা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো ঐতিহাসিক
নিদর্শনে এমন কিছুর সংমিশ্রণ পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত। প্রায়
প্রতিদিন হাজারো দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীর পদচারণয় মুখরিত হয় ঢাকার লালবাগ এলাকার এই দুর্গটি।
লালবাগ
কেল্লার নামকরণঃ স্বাভাবিকভাবে যেকেউ যদি এর নামকরণের কারণ
চিন্তা করে তাহলে স্বাভাবিকভাবে তার মাথায় আসবে যে লালবাগে থাকার
কারণেই এর নাম লালবাগ
কেল্লা রাখা হয়েছে। ধারণাটি মোটেও ভুল নয়, আসলেই এর নামকরণ করা
হয়েছে এলাকার উপর ভিত্তি করে। তবে প্রথমে এর নাম ছিল
সম্পূর্ণ ভিন্ন, যাতে এলাকার কোন প্রভাব ছিলনা। একদম শুরুর দিকে এই কেল্লার নাম
ছিল “কেল্লা আওরঙ্গবাদ”।
লালবাগ
কেল্লার ইতিহাসঃ লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৬৭৮ সালে। তৎকালীন মুঘল সম্রাট আজম শাহ এর নির্মাণ কাজ
শুরু করেন। যদিও আজম শাহ খুব কম সময়ের জন্যেই
মুঘল সম্রাট হিসেবে ছিলেন। তবুও তার অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তার এই অসাধারণ কাজটি
শুরু করেন। উল্লেখ্য আজম শাহ ছিলেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর পুত্র আর
সম্রাট শাহ জাহানের নাতি, যিনি তাজমহল তৈরির জন্যে বিশ্ব মহলে ব্যাপক সমাদৃত।এই দুর্গ নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার প্রায় এক বছরের মাথায়
তার বাবার ডাকে তাকে দিল্লিতে চলে যেতে হয় সেখানকার মারাঠা বিদ্রোহ দমন করবার জন্যে। সম্রাট আজম শাহ চলে যাওয়ার পর দুর্গ নির্মাণের
কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। তখন এই দুর্গ নির্মাণের
কাজ আদৌ সম্পূর্ণ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয়
দেখা দেয়। কিন্তু সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে তৎকালীন নবাব শায়েস্তা খাঁ পুনরায় লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু করে দেন কাজ থেমে যাওয়ার প্রায় এক বছর পরে।
পুরো উদ্যমে আবার কাজ চলতে থাকে দুর্গ নির্মাণের।তবে শায়েস্তা খাঁ পুনরায় কাজ শুরু করার প্রায় চার বছরের মাথায় দুর্গের নির্মাণ কাজ আবার বন্ধ হয়ে যায়, এরপর দুর্গটি নির্মাণের কাজ আর শুরু করা
হয়নি। নবাব শায়েস্তা খাঁ এর মেয়ে পরী
বিবি মারা যাওয়ার কারণেই মূলত শায়েস্তা খাঁ লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। পরী বিবির মৃত্যুর পরে সবার মধ্যে দুর্গটি সম্পর্কে বিদ্রূপ ধারণা জন্ম নেয়, সবাই দুর্গটিকে অপয়া ভাবতে শুরু করে দেয়।পরী বিবির মৃত্যুর পর তাকে লালবাগ
দুর্গের মাঝেই সমাহিত করা হয়, আর এরপর থেকে
একে পরী বিবির সমাধি নামে আখ্যায়িত করা হয়। পরী বিবির সমাধির যে গম্বুজটি আছে
তা একসময় স্বর্ণখোচিত ছিল, কিন্তু এখন আর তেমনটি নেই,
তামার পাত দিয়ে পুরো গম্বুজটিকে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
পরীবিবির
সমাধিঃ এই ভবনটি মুঘল
সুবেদার শায়েস্তা খানের প্রিয় কন্যা পরীবিবির সমাধি নামে পরিচিত। বাংলাদেশে এই একটি মাত্র
ইমারতে মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বিভিন্ন রং
এর ফুল-পাতা সুশোভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ অলংকৃত করা হয়েছে। কক্ষগুলির ছাদ কষ্টি পাথরে তৈরি। মূল সমাধি সৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষের উপরের কৃত্রিম গম্বুজটি তামার পাত দিয়ে আচ্ছাদিত। ২০.২ মিটার
বর্গাকৃতির এই সমাধিটি ১৬৮৮
খ্রিস্টাব্দের পুর্বে নির্মিত। তবে এখানে পরীবিবির মরদেহ বর্তমানে নেই বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
দেখার
মত যা যা রয়েছেঃ
লালবাগ কেল্লার তিনটি বিশাল দরজার মধ্যে যে দরজাটি বর্তমানে
জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া সেই দরজা দিয়ে ঢুকলে বরাবর সোজা চোখে পড়ে পরী বিবির সমাধি। সচরাচর টেলিভিশনে, খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে লালবাগ কেল্লার যে ছবিটি দেখা
যায় সেটা মূলতঃ পরী বিবির সমাধির ছবি।কেল্লার চত্বরে তিনটি স্থাপনা রয়েছে-
১। কেন্দ্রস্থলের দরবার
হল ও হাম্মাম খানা
২। পরীবিবির সমাধি
৩। উত্তর পশ্চিমাংশের
শাহী মসজিদ
কেল্লাতে
একটি মসজিদ আছে, আজম শাহ দিল্লি চলে যাওয়ার আগেই তিনি এই মসজিদটি তৈরি
করে গিয়েছিলেন। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি যে
কারো দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম। মসজিদটিতে জামায়াতে নামায আদায় করা হয়। ঢাকায় এতো পুরনো মসজিদ খুব কমই আছে।লালবাগ কেল্লাতে এখানে ওখানে বেশ কয়েকটি ফোয়ারার দেখা মিলবে, যা শুধুমাত্র কোনো
বিশেষ দিনে চালু থাকে (যেমনঃ ঈদ)। কেল্লাতে
সুরঙ্গ পথ ও আছে,
লোক মুখে শোনা যায় যে আগে নাকি
সুরঙ্গ পথগুলোতে যাওয়া যেতো, তবে এখন আর যাওয়া যায়না।
উল্লেখ্য সুরঙ্গ পথ এ যাওয়ার
কথাটি নিতান্তই শোনা কথা, এর কোনো সত্যতা
পাওয়া যায়নি।লালবাগ কেল্লায় সর্বসাধারণের দেখার জন্যে একটি জাদুঘর রয়েছে, যা পূর্বে নবাব
শায়েস্তা খাঁ এর বাসভবন ছিল
আর এখান থেকেই তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। জাদুঘরটিতে দেখার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। মুঘল আমলের বিভিন্ন হাতে আঁকা ছবির দেখা মিলবে সেখানে, যেগুলো দেখলে যে কেউ মুগ্ধ
না হয়ে পারবে না। শায়েস্তা খাঁ এর ব্যবহার্য নানান
জিনিসপত্র সেখানে সযত্নে রয়েছে। তাছাড়া তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, পোশাক, সেসময়কার প্রচলিত মুদ্রা ইত্যাদিও রয়েছে।
টিকেট
প্রাপ্তিস্থানঃ লালবাগ কেল্লার দরজার ঠিক ডান পাশেই রয়েছে টিকেট কাউন্টার, জনপ্রতি টিকেট এর দাম দশ
টাকা করে, তবে পাঁচ বছরের কম কোন বাচ্চার
জন্যে টিকেট এর দরকার পড়েনা।
যেকোনো বিদেশি দর্শনার্থীর জন্যে টিকেট মূল্য একশত টাকা করে।
বন্ধ-খোলার সময়সূচীঃ গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কেল্লা খোলা থাকে। মাঝখানে দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত
আধ ঘণ্টার জন্যে বন্ধ থাকে। আর শীতকালে সকাল
৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শীতকালেও দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত
বন্ধ থাকে। আর সবসময়ের জন্যেই
শুক্রবারে জুম্মার নামাযের জন্যে সাড়ে বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। রবিবার সহ সকল সরকারি
ছুটির দিন লালবাগ কেল্লা বন্ধ থাকে।
কিভাবে যাওয়া
যায়:
ঢাকার
গুলিস্তান, শাহবাগ বা কার্জন হলের
সামনে হতে রিকশা, সিএজি বা ট্যাক্সিক্যাবযোগে ঢাকার লালবাগ
যাওয়া যায়।